মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবগাঁথা নিয়ে ডিএমপি নিউজের বিশেষ ধারাবাহিক প্রকাশনা ‘একাত্তরের স্মৃতিকথা’- এর প্রথম পর্বের নাম থাকছে ‘লড়েছি সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য’।
লড়েছি সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশ বাহিনীর প্রায় চৌত্রিশ হাজার সদস্যের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য পাকিস্তান সরকারে আনুগত্য অস্বীকার করে কর্মস্থল ত্যাগ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেক এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরো বিপুল সদস্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। পাকিস্তান সরকার তাদেরকে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করার বাধ্যবাধকতা জারি করলে আবদুল খালেক পুলিশ সদস্যদের প্রতি একটি বার্তা দেন। স্বহস্তে লিখিত সেই বার্তায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কর্মস্থলে যোগদান না করার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। মুজিবনগর অস্থায়ী স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে পুলিশ প্রধানের সেই চিঠি হুবহু তুলে ধরা হল পাঠকদের জন্য।
বাংলাদেশের বীর পুলিশ ভাইয়েরা,
সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালি আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সন্তান, আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশের পুলিশ, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। অতীতে এবং বিগত ২৫শে মার্চ থেকে পাকফৌজ বাংলাদেশে যে নিধনযজ্ঞ ও বর্বরতা চালিয়েছে তার নজির ইতিহাসে নেই। সোনার বাংলা আজ এক প্রেতপুরী। সেখানে আজ কবরের শান্তি বিরাজ করছে। এই হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার হয়েছিল বাংলার পুলিশ বাহিনী। রাজারবাগ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা ও অন্যান্য জেলাসমূহের পুলিশ বাহিনীকে কিভাবে মেশিনগানের গুলিতে ও বোমার আঘাতে হত্যা করা হয়েছে তার করুণ দৃশ্য আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না।
আপনারা স্বচক্ষে দেখেছেন নারীহত্যা, নারীধর্ষণ, শিশু-ছাত্র-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী হত্যার বীভৎস দৃশ্য। হারিয়েছি আমরা প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজন; বেদনাক্লিষ্ট জীবনের সব সঞ্চয় ও সম্বল। ধ্বংসের ঢেউ শহর ছাড়িয়ে এখন পৌঁছেছে গ্রামেগ্রামান্তরে। রাস্তাঘাটে, হাটেমাঠে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ বাঙালি পুলিশ বাহিনীকে, ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের পরিবারকে দুঃখের অতল সাগরে। এই গণহত্যা ও ধ্বংসের তুলনা ইতিহাসে মেলে না। তাই আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলেছেন-স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পাকফৌজকে দাঁড়াতে দেবে না। পশ্চিম পাকফৌজের সর্বশেষ প্রানীটি বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। হালকা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী মেশিনগান, ট্যাঙ্ক ও বোমার মুখে যে বীরত্ব দেখিয়েছে তা কখনও ভোলা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে পুলিশের ত্যাগ ও অবদান ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
বাংলাদেশের পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের মেশিনগানের মুখে রেখে বাধ্য করা হয়েছে একথা ঘোষণা করতে-যেন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী ইয়াহিয়ার জঙ্গী শাসকদের কাজে যোগদান করেন। মুক্তিফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে আঘাত হানার জন্যই এই হীন প্রচেষ্টা। এই ঘোষণা বা ডাকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সাড়া দেবেন না। নানা কৌশলে পুলিশ বাহিনীকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলাই পাকফৌজের উদ্দেশ্য-একথা আমাদের ভুললে চলবে না। একবার ভেবে দেখুন-কেন পাকফৌজ আমাদের সহকর্মী পুলিশ ভাইদেরকে অকাতরে নৃশংসভাবে হত্যা করছে-কেন তারা বাংলাদেশের পুলিশ লাইন পুড়িয়ে জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে- কেন হাজার হাজার পুলিশকে দেশছাড়া করছে। জঙ্গী সরকার অস্ত্রের শক্তিতে শক্তিশালী এবং সেই শক্তির দাপটে ইয়াহিয়া সরকার আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই শত্রু সরকারের সাথে সহযোগিতা করা বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা বাংলাদেশের সন্তান-বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আমরা বহু ত্যাগ করেছি। আমরা আমাদের সর্বস্ব ত্যাগ করছি। মুক্তিযুদ্ধে হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছি। বাংলাদেশের শত্রুদের সাথে লড়াই করে বহু কর্মচারী শহীদ হয়েছেন। তাদের কাছে আমরা চিরঋনী। তাদেরকে চিরদিন জানাব শ্রদ্ধা। তাদের পরিবারবর্গকে জানাব সহানুভূতি-যারা শত্রুসেনাদের হাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তাদের জীবন বাঁচাবার জন্য আমরা সবকিছু করতে প্রস্তুত। বর্বর পাকফৌজের অমানসিক অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য অনেক পুলিশ কর্মচারী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদেরকে আহবান জানাচ্ছি তার যেন অবিলম্বে মুক্তিফৌজে যোগদান করে।
আমরা পুলিশ-আমরা অস্ত্র চালনা জানি। বাংলাদেশের এই মুহুর্তে আমরা আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমরা শত্রু শিবিরে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে যাবনা- শত্রুর কাছে মাথানত করব না। তাদের সাথে সহযোগিতার আহবানে আমরা সাড়া দেব না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে প্রাণ দেব। আমরা জানি যারা শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে চলেছেন-বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা তাদেরকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। পুলিশের সাথে যারা অফিসের কাজ করেছেন তাদের প্রতিও আমাদের এই একই আবেদন। পুলিশ ভাইয়েরা যার সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারা ৯নং সার্কাস এভিনিউ, কলিকাতায় (বাংলাদেশ মিশন) অথবা সুবিধামত মুজিবনগরে পুলিশ সদর দপ্তরের সংগে যোগাযোগ স্থাপন করবেন।
আমরা এ কথাই মনে রাখবো যে- আমরা বাংলাদেশের সন্তান-বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম-আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। আমরা লড়েছি সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য। এই সংগ্রামে আমরা জয়ী হবই।
জয় বাংলা
আব্দুল খালেক