মাহমুদ নবী (ছদ্মনাম)। নামকরা ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠানে অন্তত শতাধিক লোকজন কাজ করেন। সুখের সংসার। কিন্তু হঠাৎ করে এই মাহমুদ বদলে যেতে থাকেন। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খেতে শুরু করেন মাদক ফেনসিডিল। বিশেষ করে রাতে খেয়ে বাসায় ফিরতেন। এরপর সংসারে শুরু হয় অশান্তি। বিষয়টি শুরুর দিকে তার স্ত্রীও বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনি তা বুঝতে পারেন। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে তার স্বামীর। গত বছর বুঝতে পেরে তার স্ত্রী ওয়েসিস নামের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে তাকে চার মাস রাখেন তিনি। বিষয়টি খুব গোপনেই করেন। পরিবারও জানতো না। কারণ মানসম্মানের ভয়। তবে সেই মাহমুদ এখন পুরোপুরি সুস্থ। ব্যবসা দেখভাল করছেন। সংসার করছেন দিব্যি। আগের মতোই হাসি খুশিতে কাটছে তার জীবন।
মাদকাসক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার এমন গল্প আড়াইশ নর-নারীর। যারা সকলে ছিলেন মাদকাসক্ত। কিন্তু এখন তারা মাদক ছেড়ে আলোর পথে। তাদের এই কাজটিকে সম্ভব করেছে ওয়েসিস। ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর এই ওয়েসিসের পথচলা শুরু হয়। মাত্র আড়াই বছরে প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াইশ এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন।
মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মাহমুদ বলেন, আগে রাত হলেই আমার দুই থেকে তিনটি ফেনসিডিল লাগতো। খেয়ে বাসায় আসতাম। আর স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করতাম। ফলে সংসারে অশান্তি লেগে ছিল। তাছাড়া গত ৭ বছরে আমার পকেট থেকে অন্তত ৮০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। যা শুধু ফেন্সিডিল খেতেই ব্যয় হয়েছে। হয়ত সেই টাকা থাকলে আজ একটা ফ্লাট কিনতে পারতাম।
তার স্ত্রী আয়েশা (ছদ্মনাম) বলেন, আমি প্রথম দিকে খুব কাঁদতাম। আমার স্বামীকে কি স্বাভাবিক করতে পারবো? ভাবতাম। কি করব, কোথায় যাব, কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে চিকিৎসা করবো এসব নিয়ে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করতাম। একদিন ফেসবুকে জানতে পারলাম ওয়েসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে রেখে চিকিৎসা করানো যায়। এরপর সরাসরি চলে গেলাম তাদের অফিসে। সেখানে দেখা করলাম, সব খুলে বললাম।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীকে চার মাস রেখেছি। সে এখন সুস্থ। কিন্তু এই চার মাস আমার সন্তানরা জানতো না তাদের বাবা কোথায়। শুধু বলতাম, তোমার বাবা ঢাকার বাইরে একটা কাজে আছে। আমি শুধু প্রতি মাসে এসে দেখা করে যেতাম। এই চার মাস কত কষ্ট করেছি তা বোঝাতে পারব না। আজ ওয়েসিস না থাকলে আমার স্বামীকে হারাতাম। সব শেষ হয়ে যেতো আমার। এখন আগের মতো সে ব্যবসাপাতি করে, প্রতিষ্ঠানে বসে। সব কিছু স্বাভাবিক। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তবে বেশি ধন্যবাদ দিতে চাই ওয়েসিসকে।
শুধু সুজন ও মাহমুদই নয়, তাদের মতো অনেকেই মাদকাসক্ত আছেন। তাদেরকে আমরা বলবো আমরা আসেন, দরকার হলে গোপনে চিকিৎসা নেন। কারণ একটার সুস্থ হলে আপনার জীবনের বাক বদলে যাবে।
ওয়েসিস জানায়, গত দুই বছরের পথ চলা তাদের। কিন্তু এই অল্প সময়ে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াইশ নর-নারী চিকিৎসা নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে গেছে। তারা কেউই এখন মাদক গ্রহণ করে না। উল্টো কেউ মাদক গ্রহণ করলে তাকে সচেতন করে। মাদকের কুফল সম্পর্কে লোকজনকে জানান তারা।
ওয়েসিস পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ফলে এই প্রতিষ্ঠানে নেই কোন ঝক্কিঝামেলা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগীকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু এটি বিপরীত। কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে রোগীকে বুঝিয়ে তার চিকিৎসা করান তারা। এজন্য রয়েছে বিশেষজ্ঞ মনো চিকিৎসক। যিনি চব্বিশ ঘণ্টাই এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেন। ফলে তার পরামর্শ ও সেবা পেতে রোগীদের কোন বেগ পেতে হয় না। এছাড়াও তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিজস্ব হোস্টেলে তৈরি খাবার পরিবেশন। আছে বিনোদন, খেলাধুলা ও অবসর সময় কাটানোর মতো জায়গাও। তবে রোগী বা রোগীর স্বজনরা চাইলেই এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নেয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে পারেন। আছে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও যাবতীয় সুযোগ সুবিধা। রোগীদের শারীরিক ফিট রাখতে জিমের ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় ছাড়াও বিভিন্ন বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরী রয়েছে।
কলেজ ছাত্র সুজন সরকার (ছদ্মনাম)। ২০১৯ সালে স্কুল জীবনে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এভাবে চলে দুই বছর। এরপর তার বোধোদয় আসে। তিনি বিষয়টি বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করেন। পরিবারও বুঝতে পারেন তার চিকিৎসা দরকার। অবশেষে বিভিন্নস্থানে খোঁজ-খবর নিয়ে তারা জানতে পারেন, ঢাকার অদূরে ওয়েসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে এমন চিকিৎসা করানো হয়। তারা দেরি না করে তাদের সন্তানকে সেখানে ভর্তি করেন। সুজন সেখানে চার মাস থাকার পর এখন পুরোপুরি সুস্থ।
সম্প্রতি সুজনের সাথে কথা হয়। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, বন্ধুরা আমার জীবনকে শেষ করে দিয়েছিল। কিন্তু ওয়েসিস আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। তারা না থাকলে হয়ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা হতো না।
তিনি জানান , ইয়াবা গ্রহণকালে সেটি না নিলে তার পুরো শরীর ব্যথা করতো। রাতে ঘুম হতো না। খাবারের রুচি ছিল না। সব মিলে তখনকার জীবনটা ছিল অস্থির। কীভাবে এই নেশায় আসক্ত হলেন জানতে চাইলে সুজন বলেন, আমার বাবা সরকারি চাকরি করেন। প্রতিদিন আমাকে হাত খরচের জন্য দুই থেকে তিনশত টাকা করে দিতেন। সেই টাকা না খেয়ে আমি ইয়াবা সেবন করতাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই আমার জীবনটা বিপথে গিয়েছিল।
ওয়েসিসে মহিলা বা নারী মাদকাসক্ত রোগীর জন্য আলাদা ফ্লোর রাখা হয়েছে। যেখানে নারী পুলিশ সদস্যদের দিয়ে তাদের দেখভাল যত্ন খাতির করা হয়। এছাড়াও ধর্মীয় কাউন্সিলিং করানোর (যেমন: কোরআন শেখা, ধর্মীয় বিষয়গুলো মানা বাধ্যতামূলক) মধ্যদিয়ে একজন রোগীকে ধার্মিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বিশেষ করে মুসলিম হলে তাকে নামাজে অভ্যস্ত করানো হয়।
ওয়েসিস এর সাইক্রিয়াটিক মনরোগ বিশেষজ্ঞ মোর্তজা বলেন, এখানে যে কোন ধরনের মাদকাসক্তরাই আসে। আমরা কেউ আসলে প্রথমে দেখি তিনি কি ধরনের মাদক গ্রহণ করেন,তার বয়স কত এবং তার অন্য কোন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা আছে কিনা। এটা বিবেচনায় নিয়েই আমরা তার চিকিৎসা শুরু করি।
এই চিকিৎসার প্রথম ধাপটা হচ্ছে ডিটক্সিফিকেশন। তিনি কি ধরনের মাদক গ্রহণ করেন সেটার ওপর নির্ভর করে তার চিকিৎসাটা শুরু করতে হয়। আসলে মাদক গ্রহণের ওপর একজন রোগীর চিকিৎসা ও মেডিসিন নির্ভর করে। তার পাশাপাশি যদি অন্য কোন সমস্যা যেমন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকে সেটার ওপর নির্ভর করেও আমাদের ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এই ডিটক্সিফিকেশন সময়কালটা কারও এক মাস আবার কারও দুই মাস লাগে। অনেকের আবার কম সময় লাগে, কারও বেশি সময়ও লাগে।
তিনি আরও বলেন, তারপর লাইভ স্টাইল মটিভিশন প্রোগ্রাম। এটাতে মটিভিশন, সাইকোথেরাপি, সাইকো এডুকেশন এই প্রোগ্রামগুলো চলে। তার জীবন দর্শন, মাদক নিয়ে যে তার চিন্তা ভাবনা, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন সবকিছু ওঠে আসে এবং মাদক থেকে পূর্ণাঙ্গ মুক্ত হওয়ার যে উপায়টা পান তিনি। এজন্য তাকে শুধু নয়, তার পরিবার ও স্বজনদেরও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তার সুস্থ হওয়ার পথটা বের করা হয়। একজন রোগীকে শুধু আমরা সুস্থ করি না, পরবর্তীতে তার ফলোআপ রাখা হয়। চিকিৎসা নিয়ে চলে যাওয়ার পর তিনি যেন ফলোআপে আসেন সেজন্য আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা তাদের স্বজনদের বলে দেই এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তার মাঝে কোন ধরনের অস্বাভাবিক কিছু খেয়াল করলেই কোন নোটিশ ছাড়াই চলে আসবেন।
ওয়েসিস এর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এখানে রোগীর চিকিৎসা পরবর্তী ফলোআপটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এজন্য একজন রোগীর যে সাইকিয়াটিক চিকিৎসার কাউন্সিলিং দরকার সেটা ওই রোগীর যতদিন দরকার তা আমরা ফ্রিতে দিয়ে থাকি। আর এটি বিনামূল্যে করা হয়। একজন রোগীকে স্থায়ীকে ভাল করতে যা যা উদ্যোগ নেয়া দরকার হয় আমরা তার সবটাই করি। এছাড়াও আমরা চব্বিশ ঘণ্টার টেলি মেডিসিন (ফ্রি) সেবা দিয়ে থাকি। যার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। এজন্য যে কেউ পরামর্শ বা সেবার জন্য ০১৯৩০-৪০৪০৪০ নম্বরে কল করতে পারেন। যেসব অভিভাবক সন্তানদের মাদকাসক্তির বিষয়টি ধরতে পারেন না, এ বিষয়ে কারও সাথে শেয়ার করতে পারেন না, তারা এই নম্বরে কল করলে পরামর্শ পাবেন।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ওয়েসিস পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা মাদকাসক্ত তাদেরকে চিকিৎসা ও সহায়তা দেয়া হয়। মাদকাসক্তি একটি রোগ। এটি আসক্তি নয়। সেখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকে এবং সব সময় টেলিমেডিসিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। যদি কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি বা তাদের স্বজনরা ফোন করেন তবে কোনো প্রকার ফি বা টাকা-পয়সা ছাড়াই পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত এখানে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র একজনকে দ্বিতীয়বার সেবা নিতে হয়েছে। তবে সেটার জন্য তাকে এখানে আসতে হয়নি। পরামর্শ সেবার মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়েছেন।
কমিশনার জানান, ওয়েসিস মানিকগঞ্জে জমি কিনেছে। সেখানে রির্সোটের আদলে প্রতিষ্ঠান হবে। যেখানে মাদক নিরাময় কেন্দ্র হবে।
তথ্য সূত্র: ঢাকা মেইল