ডিএমপি নিউজঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষে পরিচালিত সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও তার রাজনৈতিক আদর্শের মূল সূত্রগুলো বর্ণিত হয়েছে তার লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে। কারাগারের দুঃসহ জীবনের যে খণ্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে তা বর্ণনার কৌশলও অনুভূতির ছোঁয়ায় অতুলনীয়। নিঃসঙ্গ বন্দী জীবনে বন্দী সেলের বাইরের গাছে বসে থাকা দুটো হলদে পাখিও যে বন্দীর জীবনে কতটা আনন্দ আর আশার সঞ্চার করে, কারাগারের রোজনামচার বর্ণনা না পড়লে হয়তো এমনভাবে উপলব্ধিই করতে পারতামনা। দুটো পাখি বংশ পরম্পরায় যেন তার সঙ্গি ছিল, ছিল আপনার চেয়েও আপন। ১৯৫৮ সালে জেলখানায় গিয়ে তিনি যে দুটো পাখি দেখতে পেয়েছিলেন, ১৯৬৭ সালে সেখানে গিয়ে তিনি সেই রকমই দুটো হলদে পাখি দেখতে পান। কিন্তু এরা ছিল আকারে ছোট। তাই নিঃসঙ্গ বন্দী, বঙ্গবন্ধু ধরে নিলেন, এরা আগের পাখি দুটোরই বংশধর। আর বংশ পরম্পরায় ওরা তার আত্মীয়।
পাখি দুটোকে কয়েকদিন দেখতে না পেয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১০টা-১১টার মধ্যে ওদের কথা এমনিভাবেই আমার মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুঁজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাইনা। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি আমি ওদের দেখতে পাবনা? বড় ব্যাথা পাব ওরা ফিরে না আসলে? পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দী থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না”। আহা, দুটো বনের পাখির জন্যও একজন মানুষের অন্তরে কত আকুতি!
বইটি পড়ে কারাগারের ভিতরের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারা যায়। কারাগারের অভ্যন্তরটা যে একটা ভিন্ন জগৎ, এখানে যারা বসবাস করেন, যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা যে আমাদের মতো মানুষ হয়েও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভিন্ন মানুষ সেটার জীবন্ত বর্ণনা আছে ‘কারাগারের রোজনামচায়’। বাইরের পৃথিবীতে যেসব ভাষায় মানুষ কথা বলে, জেলখানায় সেই ভাষার বাইরেও রয়েছে নিজস্ব পারিভাষিক শব্দাবলী যেগুলো পৃথিবীর কোন ভাষার অভিধানে পাওয়া যাবেনা। কারাগারের রোজনামচায় এমন বহু পরিভাষার বিবরণ পাওয়া যাবে।
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন বা বন্দীত্বের তাৎক্ষণিক কারণ যাই হোক না কেন, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬-দফাই যে এর আসল কারণ ছিল সেটা ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি জান্তারা বঙ্গবন্ধু কে নানা ভাবে হেনস্তা করার মধ্য দিয়েই জানান দিত। তাকে জেলে বন্দী করে রাখাছিল এমন একটি হেনস্তার কৌশল। তারা চেয়েছিল যে হয়তো এভাবে নির্যাতন করলে বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফা থেকে সরে আসবেন। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্যই যার জন্ম, নীতির প্রশ্নে যে তিনি ছিলেন লৌহ কঠিন সেটা পাকিস্তানি জান্তারা বুঝেতে পারেননি।
জেল খানার আধুনিক নাম হল ‘সংশোধনাগার’ বা ‘কারেকশন’। কিন্তু আমাদের দেশের জেলখানাগুলো অপরাধীদের সংশোধন তো দূরের কথা, তাদের আরো বেশি অপরাধী করে তোলে। যেখানে গিয়ে অপরাধীরা অনুশোচনা করে তাদের অপরাধের পথ পরিহারের শপথ নিয়ে একজন নিষ্কলুষ মানুষ হিসেবে সমাজে ফেরত আসার কথা, সেই জেলখানাই হল অপরাধীদের অপরাধ কৌশল শেখার উত্তম অনুশীলনাগার। সাদারল্যান্ডের সামাজিক সূত্রানুসারে অপরাধমূলক আচরণ হল একটি শিক্ষার বিষয়। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের কাছ থেকে অপরাধমূলক আচরণ রপ্ত করে। আমাদের দেশের জেলখানাগুলোর পরিবেশ লক্ষ করলে সাদারল্যান্ডের অপরাধতত্ত্বকে যে কেউ প্রতিপাদন করবেন। আর এমনি একটি বাস্তব ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচায়।
পেটের দায়ে চুরি করতে গিয়ে পুরান ঢাকার ১৩ বছরের বালক লুদু জেলে যায়।পিতার দ্বিতীয় বিবাহ করার পর সংসার ত্যাগ, বড় ভাইয়ের নির্যাতন সইতে না পেরে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া এবং সেখানে গোপাল নামের এক চোরের সাথে সখ্য গড়ার মধ্য দিয়েই লুদু শুরু করে তার অপরাধী জীবন।প্রথমবার জেলে গিয়েই সে পেয়ে যায় অন্য এক ওস্তাদ।বাইরে এসে ওস্তাদের সাথে চুরি করতে গিয়ে সে আবার ধরা পড়ে জেলে যায়।জেলখানায় হাজার ধরনের অপরাধীদের হাজার ধরনের অপরাধ কৌশল।কিন্তু লুদু চুরির কৌশলেই হাত পাকাতে চেষ্টা করে।চুরি বা ছিনতাইয়ের মাল, বিশেষ করে সোনার জিনিসপত্র, গলার ভিতরে জমা রাখার জন্য সে গলার ভিতরে বিশেষ কৌশলে খোকড় বা গর্ত তৈরি করে।শহরের অনেক পুলিশ সদস্যদের সাথে তার পরিচয় হয়।তাদের বকসিস বা মাসোহারা দিয়ে সে চুরি করে।অনেক সময় চুরি করতে না পারলে মাসোহারা দিতে পারে না।তখন পুলিশ তাকে ইচ্ছে মত গ্রেফতার করে।এভাবে জেলখানায় হয়েও ঠেলুদুর আসল ঘরবাড়ি।
ভিক্টোর হুগোর লামিজারে বল উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের জ্যাঁভ্যালজ্যাঁ তার বিধবা বোনের ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের জন্য এক খণ্ড রুটি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে যায়।এর পর শুরু হয় তার সত্য-মিথ্যার অপরাধী জীবন।কিন্তু এ ধরনের চরিত্রের মানুষের অভাব যে বাংলাদেশেও নেই তার খবর কে রাখে? নিজে রাজনৈতিক কারণে বন্দী হয়েও কারাগারের অপরাধী-অভিযুক্ত বা দায়ে পড়ে জেলে যাওয়া অতি নিম্নস্তরের মানুষের জীবনও যে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি লুদুর গল্প তারই প্রমাণ।
কারাগারের রোজনামচা একজন রাজনৈতিকি বন্দীর আটপৌরে জীবনের কাহিনী হলেও এ কাহিনী আসলে ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য পর্বের জীবন্ত বর্ণনা।একটি জাতির জন্য একটি সার্বভৌম দেশ গড়ার পিছনের ইতিহাসও এখানে বাদ যায়নি।১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব যে বাংলাদেশের স্বধীনতার সূত্রপাত ছিল সেটা বঙ্গবন্ধু তার রোজনামচায় স্পষ্ঠ করে তুলে ধরেছেন।শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি যে অংশটুকু লিখেছিলেন তার শেষ পরিচ্ছদ ছিল, “আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী।আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা দাবি পেশ করেছি তার উপর ব্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হল।আল্লাহর মহিমা বোঝা কষ্টকর।
ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই যে পাকশাসকদের গ্রেফতার এড়াতে বঙ্গবন্ধু কখনও আত্মগোপন করেছিলেন বা গ্রেফতার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু তাই বলে যে গ্রেফতার বা জেল জীবনকে তিনি পছন্দ করতেন তা নয়।দলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে দ্রুত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া, সংসার ধর্মপালন, শারীরিক আরাম-আয়েস ইত্যাদির জন্যএকজন রাজনীতিবিদের অবশ্যই মুক্ত জীবন প্রয়োজন।
কিন্তু যে শাসক চক্র বঙ্গবন্ধুকে জেলে বন্দী করে রাখাকেই তার আদর্শ বা সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রধানতম কৌশলরূপে গ্রহণ করে তাদের থেকে পালিয়ে বেড়ানোর পরিবর্তে একজন নিয়মতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিবিদের তাদের জেলেবন্দীত্ব বরণ করার চেয়ে উত্তম পাল্টা কৌশল আর কি হতে পারে? কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানি শাসকরা, ‘মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে জেলে নিতে পারে না। আর তাইতো যতবারই বঙ্গবন্ধু তার বন্দীত্ব শেষ করে সাময়িককালের জন্য বাইরে এসেছেন, তিনি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তা নিয়ে জেলখানা ত্যাগ করেছেন এবং তার ৬-দফার আন্দোলনকে আরো বেশি বেগবান পেয়েছেন।
দীর্ঘ কারা জীবনের নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে বঙ্গবন্ধু তার বন্দী সেলের বাইরের অঙ্গণে বাগান করেছেন, মুরগী পালন করেছেন, কবুতরের বাচ্চা ফুটিয়েছেন।কিন্তু এসবের চেয়ে বড় বিষয় ছিল তিনি তার আশেপাশের সকল মানুষ তারা জেলখানার কর্মচারী হোক বা সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীই হোক তাদের সাথে পিতৃত্ব সুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।তার পরিবার থেকে দেয়া উন্নত মানের খাবার তিনি অন্যদের ছাড়া খেতেন না।তার সেলে রান্নার বরাদ্দ বাঁচিয়ে তিনি অন্যান্য বন্দীদের জন্য খিচুড়ি রান্না করতেন।অবমাননাকর ও নির্যাতনমূলক বন্দীত্ব জীবনে একজন মহৎ হৃদয় মানুষ ছাড়া কেউই এমন সাবলীল আচরণ করতে পারেন না।কারাগারের রোজনামচা পাঠকদের তাই, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে আরো নিবিড়ভাবে জানারও উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়।
লেখকঃ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
এআইজি,পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স,ঢাকা।