এই নগরের মানুষ প্রতিদিনই বাসে চিড়ে চ্যাপ্টা হন। চাতক পাখির মতো গলা বাড়িয়ে এক চিলতে আকাশ দেখার চেষ্টা করেন তারা। পাশ দিয়ে সাই করে চলে যায় চকচকে দামী গাড়ি। ওই গাড়িতে ওড়ে লাল সবুজের পতাকা। কিছু গাড়িতে থাকে শুধুই স্ট্যান্ড। মন্ত্রীদের গাড়িতে পতাকা ওড়ে। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীদের গাড়িতে ওড়ে না, থাকে শুধু স্ট্যান্ড। আবার নিজের নির্বাচনী এলাকায় প্রতিমন্ত্রী ঠিকই গাড়িতে পতাকা ওড়ান। কেন এমন হয়? এটা কি তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয়। মোটেই তা নয়। আইন করে তাদের এ অধিকার দেওয়া হয়েছে।
সব মন্ত্রী সড়কপথে গাড়িতে ও জলপথে জলযানে জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারেন। ব্যতিক্রম শুধু প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। তারা কেবল রাজধানীর বাইরে গেলে গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারেন। আর নিজ নির্বাচনী এলাকায় রওনা হলে রাজধানীর বাসা থেকেই গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারেন।
গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, সংসদের স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, বিরোধীদলীয় নেতার। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আকাশ পথে এয়ারক্রাফটেও পতাকা ওড়াতে পারেন। এই পাতাকা ওড়ানোয় বিভাজন কেন জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এটা প্রাধিকারের বিষয়।
এতে পদগুলোর অবস্থানগত পার্থক্য বোঝা যায়। শুধু পতাকা দিয়ে নয়, সম্মানী, ভাতা, সুযোগ সুবিধায়ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বিভাজন টানা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ রুলস, ১৯৭২’ অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় চলাচলের সময় গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারেন না প্রতিমন্ত্রীরা। তবে বিভিন্ন সময় প্রতিমন্ত্রীরা তাদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের অধিকার চেয়েছেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিষয়টি তোলা হয়। মন্ত্রিসভার ওই অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রতিমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, পূর্ণ মন্ত্রীদের মতো তারাও গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে চান। তারা এর পক্ষে বিভিন্ন ধরনের যুক্তি তুলে ধরেন। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, প্রতিমন্ত্রীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হলে ফ্ল্যাগ রুলস সংশোধন করলেই চলবে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ফ্ল্যাগ রুলস সংশোধনসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিলে তা পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই প্রস্তাবে প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীদের গাড়িতেও পতাকা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। এর আগে ২০১২ সালেও প্রতিমন্ত্রীরা তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুযোগ চেয়েছিলেন।
বর্তমান কেবিনেটের একজন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রীদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সম্মানিত করা হয়। তারা প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব করেন। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিনদেশি বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব। সব প্রতিনিধিত্ব একসঙ্গে করেই প্রধানমন্ত্রী। সেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তো আমরাও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি। তাহলে আমরা কেন এই সম্মানটুকু পাব না?’
জাতীয় পতাকার বাইরেও বিভিন্ন ধরনের পতাকা রয়েছে, যা গাড়িতে ব্যবহার করা হয়। বিচারকদের জন্য বিশেষ মনোগ্রামের পতাকা রয়েছে। বিচারকদের মতো সচিবরাও বিশেষ ধরনের পতাকা ব্যবহার করতে চান, যা তারা একাধিক সচিব সভায় উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু আপাতত তা হচ্ছে না। কোনো সিটি মেয়র যদি মন্ত্রী সমমর্যাদায় আসীন হন তবে তিনিও গাড়িতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারেন। তবে দেশের প্রায় সব পৌর মেয়রদের গাড়িতেই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড এর অবাধ ব্যবহার দেখা যায়। বাদ পড়েন না বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও।
পূর্ণমন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপ্রিম এক্সিকিউটিভ অথরিটি। প্রতিমন্ত্রী পূর্ণমন্ত্রীর আন্ডারেও হতে পারেন আবার ইন্ডিপেন্ডেন্ট চার্জও পেতে পারেন। সাধারণত প্রতিমন্ত্রীদের সেনসেটিভ মিনিস্ট্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় না। পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন কেবিনেট মিনিস্টার। কেবিনেট মিনিস্টাররাই কেবিনেট বৈঠকে অংশ নেবেন, প্রতিমন্ত্রীরা নন। তবে যদি কোনো মন্ত্রণালয়ে পূর্ণমন্ত্রী দায়িত্বে না থাকেন তবে প্রতিমন্ত্রী ক্যাবিনেট সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাদেরকে আমন্ত্রণ জানালে তারা কেবিনেট বৈঠকে অংশ নিতে পারবেন। তবে বাংলাদেশে এ চর্চা নেই। বাংলাদেশে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা মিলে একাকার হয়েই বৈঠক করেন।
কম পদমর্যাদার কারণে প্রতিমন্ত্রীর সম্মানী ও বেতন-ভাতা কম। প্রতিমন্ত্রী যদি কেবিনেট মিনিস্টারের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করেন তবে তাকে স্বতন্ত্র দায়িত্বের প্রতিমন্ত্রী বলা হয়। প্রতিমন্ত্রীকে সাধারণত একজন পূর্ণমন্ত্রীর কাজের চাপ ও দায়িত্ব কমানোর লক্ষ্যে নিয়োগ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী পূর্ণ মন্ত্রীর অধীনে থেকে কোনো বিভাগের অংশবিশেষের দায়িত্ব পালন করেন। তবে কাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক করবেন তা নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর।
অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ হচ্ছে পূর্ণমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত পরিষদ। সাধারণত গাড়ি, বাড়ি, চিকিৎসা খরচসহ অন্তত ১৩ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন এই পরিষদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা। তারা কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা নির্ধারণ করা আছে ‘দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) অ্যাক্ট’-এ।
রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী মন্ত্রীর বেতন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। প্রতিমন্ত্রীর বেতন ৯২ হাজার ও উপমন্ত্রীর ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা। দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন মন্ত্রী সরকারি ব্যয়ে একটি সুসজ্জিত বাসভবন পান বিনা ভাড়ায়। প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী একই সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে মন্ত্রী যদি সরকারি বাড়িতে না থেকে নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাহলে সরকার থেকে তিনি মাসে ৮০ হাজার টাকা করে ভাড়া পাবেন। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পাবেন ৭০ হাজার টাকা করে। এছাড়া নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে বসবাস করলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে তিন মাসের বাড়ি ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা পান তারা। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা খরচ সরকার বহন করে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সরকারি খরচে একটি করে গাড়ি সুবিধা পাবেন। এই গাড়ি পরিবহন পুল সরবরাহ করে। এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় ভ্রমণের সময় তারা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেকোনো সংস্থা বা দপ্তর থেকে একটি জিপ গাড়ি পাবেন। জ্বালানি বাবদ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন। সরকারি বাড়ি সাজসজ্জা করতে একজন মন্ত্রী প্রতি বছর পাঁচ লাখ টাকা পান। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পান চার লাখ টাকা করে। এছাড়া তাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন ব্যয় যা আসে সরকার পুরোটাই বহন করে। দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা মাসে ১০ হাজার টাকা করে আপ্যায়ন ভাতা পান। নিজ এলাকার মসজিদ, মন্দির উন্নয়নসহ এলাকার মানুষের দাতব্য কাজে একজন মন্ত্রীকে বছরে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ খাতে প্রতিমন্ত্রী পান সাড়ে ৭ লাখ ও উপমন্ত্রী পান ৫ লাখ টাকা করে। এ টাকার মধ্যে মন্ত্রী চাইলে একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দিতে পারেন। প্রতিমন্ত্রী দিতে পারেন ৩৫ হাজার আর উপমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী উপসচিব পদমর্যাদার একজন একান্ত সচিব (পিএস) পান। এ ছাড়া একজন সহকারী একান্ত সচিব এবং দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, একজন জমাদার, একজন আরদালি, দুজন অফিস সহায়ক ও একজন পাচক (রাধুনী) পেয়ে থাকেন। এছাড়া তাদের দৈনিক ভাতা রয়েছে। স্বেচ্ছাধীন তহবিল পান। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরীতো আছেই। সূত্র: দেশ রূপান্তর