ওয়ার্কশপ থেকে চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এরই মধ্যে জাহাজটি প্রায় তিন হাজার ২০০ টন ওজনের ৭বি নম্বর স্প্যানটি (সুপার স্ট্রাকচার) নিয়ে সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছেছে। আগামীকাল স্প্যানটি পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে স্থাপন করার কথা রয়েছে। প্রথমে অস্থায়ী বেয়ারিংয়ে এটি বসানো হবে। পরে স্থায়ী বেয়ারিংয়ে স্থাপন করা হবে।
ইতিমধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপ থেকে প্রায় তিন হাজার ৬০০ টন ক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের ‘তিয়ান ই হাউ’ জাহাজে করে ধূসর রঙের ১৫০ মিটার দীর্ঘ সেতুর এই স্প্যান টেনে নেওয়ার সময় কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে যায়। দূর থেকেই এ দৃশ্য অবলোকন করে আনন্দে উদ্বেল পদ্মাপাড়ের মানুষ।
স্প্যানবাহী জাহাজটি ফেরি চ্যানেল ক্রস করার সময় এই চ্যানেলে ফেরিসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ৪৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দুটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার। একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে দুটি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বাংলাদেশের নিজেস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী মেগা প্রকল্পে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত এ সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের পাশাপাশি রেল চলতে পারে সে লক্ষ্যে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলার ৫৮৮ দশমিক ২৪ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু হয়েছে বলে জানান পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক এস কে চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, সব ঠিক থাকলে এ বছরের শেষের দিকে এ প্রকল্পের রেললাইনের কাজ জোরেশোরে শুরু হবে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হবে। এরপর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬১ কিলোমিটার রেলপথ প্রশস্ত করা হবে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতুর রেলপথের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে চীনের পছন্দের সে দেশের একটি কোম্পানি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড কোম্পানি।
মূল সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, ত্বরিত গতিতে শুরু হয়েছে ফোর লেন সড়ক ও রেললাইন প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়া। নদীশাসনের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুর মূল নির্মাণকাজের জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দুই পারে সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট কাজ করে চলেছে।
এ ছাড়া পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। আর রেললাইনের কাজ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড কোম্পানি। এই সেতু বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেবে বলেও তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, সব মিলিয়ে গড়ে সেতুটির প্রায় ৪৭ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কংক্রিট আর স্টিলের নিখুঁত গাঁথুনিতে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম দোতলাবিশিষ্ট এ সেতু। এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি সেতু হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এই সেতু নতুন দিগন্তের সূচনা গড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের যোগাযোগ নিশ্চিত হবে।