প্রসূতির মৃত্যু এখনও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বড় একটি সমস্যা। আর এই মৃত্যুর প্রধান একটি কারণ রক্তক্ষরণ।
আজ থেকে ১৪ বছর আগে অত্যন্ত অল্প খরচে সহজ একটি পদ্ধতিতে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় বাতলে দিয়েছিলেন গাইনির ওপর বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক ডা: সায়েবা আক্তার।ক্যাথেটার দিয়ে একটি কনডম প্রসূতির জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে তা বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রক্ত বন্ধ করতে তাঁর আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি এখন বিশ্বের বহু দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে।
২০০৩ সালের পর থেকে বিশ্বের অনেক শীর্ষ সারির মেডিকেল জার্নালে তার এই গবেষণা পত্রটি ছাপা হয়েছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।এই পদ্ধতি নিয়ে ভাষণ এবং প্রশিক্ষণ দিতে তিনি এখন ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছেন।বিবিসি বাংলার শাকিল আনোয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডাক্তার সায়েবা আক্তার বলেন ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে গাইনি বিভাগের প্রধান হিসাবে কাজ করার সময় তিনি এই পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করে সফল হয়েছিলেন।
তিনি বলেন সেই সময় একদিন অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলেন একজন প্রসূতির প্রথম বাচ্চা হতে গিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তাই তার জরায়ু ফেলে দেবার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।”কারণ মেয়েটির অনেক ব্লিডিং হচ্ছে, বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমি ডাক্তারদের বললাম তোমরা একটু অপেক্ষা করো- আমি একটু দেখি।ডা: সায়েবা আক্তার বলছিলেন খুবই অল্পবয়সী সেই মেয়েটির জরায়ু ফেলে দেবার জন্য সব কিছু তখন প্রস্তুত। এসময় তিনি একটি কনডম নিয়ে গেলেন ওটিতে। আমি কনডমটা যখন একটা ক্যাথেটারের সাথে বেঁধে জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে সেটা স্যালাইন ভরে ফুলিয়ে দিলাম, পনের মিনিটের ভেতর তার ব্লিডিং বন্ধ হয়ে গেল।
তখনই তার মনে হয়েছিল এই ব্যবস্থাটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এরপর ২০০১ সাল থেকে পরীক্ষা শুরু করলেন তিনি এবং ২৩জন রোগীর ওপর তা পরীক্ষা করে দেখলেন। ওই ২৩টা রোগীর জীবন যখন আমরা বাঁচাতে পারলাম এবং দেখলাম আল্লার রহমতে একটা রোগীর ক্ষেত্রেও কোন কমপ্লিকেশন হলো না, তখন আমরা ওই স্টাডির ফলাফল অনলাইন একটা জার্নালে প্রকাশ করলাম ২০০৩ সালে।
২০০৩ সাল থেকেই তার এই পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু হয় বলে জানালেন ডা: আক্তার।তিনি বলেন ওই সময় থেকেই এটি যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় গাইডলাইন্সের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়, তাই ২০০৩ থেকেই বাংলাদেশের সব হাসপাতালে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু হয়।তিনি বলেন এই পদ্ধতি শুধু যে প্রসূতির মৃত্যু কমিয়েছে তা নয়, বহু মায়ের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও এই পদ্ধতি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। রক্তক্ষরণের কারণে সন্তানজন্মের সময় আগে যেসব মায়ের জরায়ু কেটে ফেলে দেওয়া হতো, তাদের জরায়ু রক্ষা করা এখন সম্ভব হয়েছে।২০০৩ সার আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃমৃত্যুর যে হার ছিল এই পদ্ধতি ব্যবহারের পর তা প্রায় অর্ধেক কমে পৃথিবীর অনেক দেশে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধে অল্প খরচের এই পদ্ধতি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে যা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে “সায়েবাস্ মেথড” নামে।
ডা: আক্তার বলেন ২০০৫ সালে এই পদ্ধতির খবর ইন্টারন্যাশানাল মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়।২০১০ সালে ব্রিটিশ জার্নাল অফ অবস্টেট্রিক্স ও গাইনিতেও বেলুন ট্যাম্পোনয়েড পদ্ধতির ওপর একটি পর্যালোচনা প্রকাশিত হয় যেখানে অল্প খরচে এই কনডম ক্যাথেটার পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উদ্ভাবনের খবর বের হয়। বলা হয় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বহু মায়ের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। ২০১১ সালে রয়াল কলেজ অফ অবস্টেট্রিক্স ও গাইনির সর্বোচ্চ সম্মান পান ডাক্তার সায়েবা আক্তার।
তিনি জানান এশিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার সর্বত্র এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, এমনকী পূর্ব তিমরেও গিয়ে তিনি এই পদ্ধতি সম্পর্কে চিকিৎসক, নার্স ও বিশেষ করে ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।