কামরাঙ্গীরচর এলাকার আলীনগরের খালপাড় থেকে গত বছরের ১৮ নভেম্বর পাঁচ বছর বয়সী শিশু খুশিমণিকে উদ্ধার করে কামরাঙ্গীরচর থানার পুলিশ। স্বজনের খোঁজ না পাওয়ায় খুশিকে রাজধানীর তেজগাঁও থানা চত্বরে অবস্থিত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয়। পরে স্বজনদের খুঁজে পেতে মাইকিংয়ের পাশাপাশি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের ফেসবুক পেজে খুশিমণির ছবিসহ পোস্ট দেয় পুলিশ। গত ২৯ নভেম্বর নেত্রকোনার মদন উপজেলায় খুশিমণির বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবুল হাশেম ও মা প্রতিবন্ধী সুফিয়া বেগমের খোঁজ পাওয়া যায়। সেদিনই মা-বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয় খুশিমণিকে।
তেজগাঁওয়ে বাসায় বাক্-প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে একা রেখে মা-বাবা তাঁদের কর্মস্থলে যেতেন। পরে ওই দম্পতি কিশোরীর শারীরিক পরিবর্তন খেয়াল করেন। কিশোরীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, সে অন্তঃসত্ত্বা। অভিযোগ আসে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। তদন্তে জানা গেছে, প্রতিবেশী বাচ্চু মিয়া কিশোরীকে তার মা-বাবার অনুপস্থিতে ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। ডিএনএ পরীক্ষায় বাচ্চু মিয়াকে ধর্ষক হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
হারিয়ে যাওয়া শিশু খুশিমণিকে উদ্ধার কিংবা বাক্-প্রতিবন্ধী ওই কিশোরীর অভিযুক্ত ধর্ষককে গ্রেপ্তারের মতো নানা কাজ করছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। সেন্টারটি থেকে পাচারের শিকার, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারসহ নারী-শিশুদের আইনি সহায়তা ও সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, অ্যাসিড আইন, পর্নোগ্রাফিসহ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলারও তদন্ত করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে নগরীর তেজগাঁও থানা চত্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অধীন উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চালু করে ডিএমপি। গত এক যুগে এ সেন্টার ১৮ হাজার নারী-শিশুকে আইনি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে সেবা দেওয়া হয় ১০ হাজার নারী ও শিশুকে। গত ১০ বছরে নারী ও শিশুদের করা মোট ৪ হাজার ৩৮০ মামলার তদন্ত করেছে এ সেন্টার।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, সহিসংতার শিকার নারীদের বক্তব্য শুনে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। এরপর সহায়তা দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়া, আটকে পড়া নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হয় এখানে। স্বাভাবিক প্রয়োজনে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঁচ দিন থাকা যায়। বিশেষ প্রয়োজনে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুকে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত রাখা হয়। এ সময় থাকার জায়গার পাশাপাশি খাবারসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়া হয়। তদন্তে মামলার বাদী ও ভুক্তভোগীকেও সহায়তা দেওয়া হয়। পরিবারে একত্রীকরণ, পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় পাঠানো হয় এখান থেকে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে ১০টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে।
ডিএমপির ৫০ থানার স্পর্শকাতর মামলা, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) তদন্তাধীন নারী ও শিশুবিষয়ক মামলা এবং জিডির বাদী হওয়া ভুক্তভোগীদের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে পাঠানো হয়। ঢাকার আশপাশের জেলার মামলা ও জিডির বাদীর ভুক্তভোগীদেরও এখানে পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন আদালত থেকে পাঠানো ভুক্তভোগীকে এখানে সেবা দেওয়া হয়।
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপির উপকমিশনার হামিদা পারভীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সেবা নেওয়ার প্রত্যাশা বেড়েছে। এখান থেকে ২০২০ সালে ১ হাজার ৯৯৪ জন এবং গত বছর ২ হাজার ২৪ জন নারী ও শিশুকে আইনি সহায়তা ও সেবা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের হটলাইনে অন্তত ২০০ জন যোগাযোগ করেন। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ জন সশরীরের অভিযোগ জানান। তাঁদের মধ্যে অনেকে মামলা বা জিডি করতে চান না। তাঁরা সমাধান চান। তখন উভয় পরিবারকে নিয়ে বসে সমস্যার সমাধান করা হয়।
হামিদা পারভীন আরও বলেন, বিদেশি নারীকে বিয়ে করে এনে দেশে নির্যাতন ও দেশের নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলে তাঁদের সমস্যা সংশ্লিষ্ট দেশের মাধ্যমে সমাধান করে দেয় এ সেন্টার। ভারত, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও মিসরে এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সমাধান করে দিয়েছে এই সেন্টার।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, এই সেন্টার থেকে গত ১০ বছরে নারী ও শিশুদের করা মোট ৪ হাজার ৩৮০ মামলার মধ্যে ২ হাজার ৪০৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ২৩৭ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৩৮ মামলা তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্ত শেষ হলেও ডিএনএ ও মেডিকেল পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়ায় অভিযোগপত্র আটকে আছে। এ ছাড়া ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুক ও অপহরণের অভিযোগে আদালতে হওয়া ৪৮ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ৪৪ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪টি মামলা তদন্তাধীন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নারী ও শিশুদের সেবার দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আগেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন প্রতিষ্ঠানটির কলেবর ও অবকাঠামো-সুবিধা আরও বাড়িয়ে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের আস্থার কেন্দ্রে পরিণত করতে চান তিনি।
কৃষ্ণপদ রায় আরও বলেন, বিভাগীয় শহরগুলোয় এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা আরও উপকৃত হবে।
ভুক্তভোগীরা উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের হটলাইন নম্বর (০১৩২০০৪২০৫৫, ০১৭৪৫৭৭৪৪৮৭), ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে অভিযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’ ব্যবহার করেও অভিযোগ জানানো যায়।