করোনা মহামারি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ আগ বাড়িয়ে নাগরিকদের সেবায় নেমে পড়ায় জনগণের আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করে চলেছে। এই আস্থা স্থায়ী করতে করোনাকালে অর্জিত সেবার মানসিকতা বজায় রাখার সঙ্গে যেকোনো মানুষকে সম্মান দেখাতে হবে পুলিশ সদস্যদের। এ লক্ষ্যে পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আনাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম বিপিএম (বার)। কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একই সঙ্গে বলেছেন, সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে যেভাবে নেতিবাচক সমালোচনা শুরু হয়, সে কারণে দীর্ঘদিনেও পুলিশের ওপর আস্থা তৈরি হচ্ছে না। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এস এম আজাদ ও রেজোয়ান বিশ্বাস।
কালের কণ্ঠ : শুরুতে জানতে চাই, করোনাকালে কিভাবে ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন?
শফিকুল ইসলাম : করোনার এই সময়ে পুলিশিংয়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি। টোলারবাগে প্রথম রোগী শনাক্তের পর সেখানে উদ্যাগ নিয়ে লকডাউন করে দিই। সব কিছু বন্ধ হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদে পড়ে। আমরা প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করি। বস্তিতে বস্তিতে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি। যারা ত্রাণ দিয়েছে তাদের সুরক্ষার মাধ্যমে ত্রাণ দেওয়ার কাজে সহায়তা করেছি।
কালের কণ্ঠ : এখন পুলিশকে অনেক জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যা আসলে পুলিশের কাজ নয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না?
শফিকুল ইসলাম : এটি একটি মহামারি। বিশেষ অবস্থা। আমরা না বুঝেই প্রথমে বিপদে পড়া মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। কখন মাস্ক আসবে, পিপিই আসবে—এর জন্য চিন্তা করিনি। এটাই বিষয়, মানুষকে নিরাপদে রাখা। এই সময়ে যেহেতু মানুষ বেশি ঘরে ছিল, ফলে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কোনো সমস্যাই হয়নি।
কালের কণ্ঠ : পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বাধিক করোনায় আক্রান্ত হয়েও মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মানুষের আস্থা অর্জন করে চলেছে ডিএমপি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুলিশের এই বদলে যাওয়া মানসিকতা থাকবে তো?
শফিকুল ইসলাম : করোনাকালে কাজের মাধ্যমে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। দেখুন, মানুষ প্রশংসা পেলে ভালো কাজ করে। আপনারা ঘুমান, পুলিশের অনেক সদস্য সারা রাত জেগে পাহারা দেন। ইফতারের সময় সবাই বাড়ি যান, পুলিশ আপনাদের পথকে স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে। তবে কখনো বিচ্যুতি ঘটলে এমন করে বলা হয় যে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ থাকে না। এমন সমালোচনার কারণে দীর্ঘদিনেও পুলিশের ওপর আস্থা তৈরি হচ্ছে না।
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতিমুক্ত সমাজের উপযোগী ডিএমপি গঠন করতে আপনার চেষ্টা কতটা সফল? এই সফলতা ধরে রাখতে আপনার পরবর্তী লক্ষ্য কী হবে?
শফিকুল ইসলাম : এমন একটি সেবা খাত আপনি খুঁজে পাবেন না যেখানে দুর্নীতি নেই। আমাদের সেবাদানের মূল জায়গা থানায় মানুষ মামলা করতে যায়, জিডি করতে যায়। আমি যখন দায়িত্ব নিলাম, যিনি জিডি করতে যান বা মামলা করতে যান, তাঁর সঙ্গে পরে ফোনে যোগাযোগ শুরু করলাম। জানতে চাইছি, সেবা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন কি না, টাকা-পয়সা দিতে হয়েছে কি না, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে নিতে আপনার গাড়িভাড়া দিতে হয়েছে কি না। সব বিষয় মনিটর করা হয়। আমি একেবারে প্রমাণ দিয়ে বলতে পারব না যে আমাদের এখানে এখন কিছু হয় না। তবে পরিবর্তন হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সপ্তাহে তিন-চার দিন থানায় অফিস করছেন। তবে ডিসি গিয়ে বসে থাকলেও দেখা যায় ওনার কাছে কেউ আসে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে থানায় হয়তো এই ব্যবস্থা কাজে আসবে।
কালের কণ্ঠ : মাদকের আগ্রাসন রোধ করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
শফিকুল ইসলাম : মাদকের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা অভিযান চালিয়ে যারা বিক্রি করছে তাদের ধরছি। এ সত্ত্বেও আগ্রাসন কমছে না। তাই এখন মাদক কারবারিদের ধরে ক্রেতাদের শনাক্ত করে তাদের পরিবারকে বের করা হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করা হবে। পুলিশের যারা জড়িত থাকবে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে।
কালের কণ্ঠ : মানুষকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে কোন কোন জায়গায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন?
শফিকুল ইসলাম : আমাদের যে মানসিক অবস্থা—একটা মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলা, আস্থায় নিয়ে আইনগত দায়িত্ব পালন করা, সে ক্ষেত্রে মনে হয় আমরা পিছিয়ে আছি। মানসিকতার এই জায়গায় আমরা অনেকটা দুর্বল। একজনকে আমরা বললাম দাঁড়ান, তখন তিনি যদি পাঁচ গজ দূরে গিয়ে দাঁড়ান তখন বলছি—‘এই বেটা, তোকে এখানে দাঁড়াতে বললাম তুই ওখানে গিয়ে দাঁড়ালি ক্যান?’ এই যে আচরণ, এটা যদি আমি পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে হবে না। আপনি কাজ করে সন্তুষ্ট করলে মানুষ কিন্তু আপনার ছোটখাটো ত্রুটি পেলেও কিছু মনে করবে না। মূলত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ গড়ে তুলতে পারাটাই আমি করি সবচেয়ে বড় সফলতা। আইজিপি স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী সব পুলিশ সদস্যের মধ্যে এই বোধটি তৈরি করার কাজ করছি। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সানুষের দোরগোড়ায় সেবা নেওয়ার চেষ্টা করছি।
কালের কণ্ঠ : আপনার অভিজ্ঞতায় এই কোটি মানুষের নগরীর নিরাপত্তায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন?
শফিকুল ইসলাম : এত বড় একটি মহানগরীতে দুই কোটির ওপর মানুষ বাস করে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এখানে আসে। পুরো শহর নজরদারি করা কঠিন। ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স কার্যকর না করা গেলে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। এ জন্য সেইফ সিটি নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শহরের ১০০ পয়েন্টে ৬০০ সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা শহরকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হবে। এটা হলে অপরাধী যেমন ভয় পাবে, তেমনি মানুষ চলতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
কালের কণ্ঠ : ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, এর মাধ্যমে কী সুফল আসছে?
শফিকুল ইসলাম : এ ব্যাপারে আমরা দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও মানুষকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সচেতন করতে পারিনি। আমার বাসায় একজন ভাড়াটিয়া এলে, চলে গেলে সে তথ্য আমি পুলিশকে জানাচ্ছি না। এটা করা কিন্তু নাগরিক হিসেবে নিজের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন। আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। এখন তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখি, তা ঠিক নেই। একই ব্যক্তি অন্য জায়গায় গিয়ে যদি নাম পরিবর্তন করে সেটা বের করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমরা এখন ভেরিফিকেশনে গুরুত্ব দিচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনি যদি পুলিশ না হতেন, তাহলে একজন নাগরিক হিসেবে কেমন পুলিশ চাইতেন?
শফিকুল ইসলাম : মানুষ হিসেবে এমন পুলিশ চাইতাম যে পুলিশ নাগরিককে যথাযথভাবে সম্মান করে। তাহলে পুলিশ সম্পর্কে মানুষের যে বিরূপ ধারণা হয় সেটা আর থাকবে না।
সূত্র: কালের কন্ঠ