কারবালার স্মরণে আশুরার দিনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাজিয়া মিছিল বের করেছে শিয়া মুসলমানরা; গত কয়েক বছরের মতই কঠোর নিরপত্তার মধ্যে চলছে এই আনুষ্ঠানিকতা।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার পুরান ঢাকার হোসেনী দালানের ইমামবাড়া থেকে আশুরার প্রধান তাজিয়া মিছিল শুরু হয়।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের পরনেই কালো পাজামা-পাঞ্জাবি, কেউ পরেছেন সাদা-কালো পোশাক। তাদের হাতে হাতে ঝালর দেওয়া লাল, কালো, সবুজ ঝাণ্ডা। বুক চাপড়ে, ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতমে ফোরাত তীরের কারাবালার ঘটনাকে স্মরণ করছেন তারা।
হাজারো মানুষের এই শোক মিছিল উর্দু রোড, লালবাগ গোর-এ-শহীদ মাজার, আজিমপুর, নিউ মার্কেট হয়ে ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কের পশ্চিম প্রান্তে প্রতীকী ‘কারবালা’ প্রাঙ্গণে গিয়ে পৌঁছে দুপুর ১টায়।
ইমামবাড়া থেকে যখন মিছিলটি শুরু হয়। তখন রাস্তার দু’পাশে উৎসুক মানুষের ভিড়।
রাস্তার দুই পাশে এসময় বিভিন্ন বয়সে মানুষ তাজিয়া মিছিল দেখতে জড়ো হয়। এ সময় রাস্তার দু পাশে দাঁড়ানো অনেককে দুধ মিছিলের মাঝে রাস্তায় ঢেলে দিতে দেখা যায়। অন্য ধর্মালম্বী নারী-পুরুষদেরও রাস্তার পাশে দেখা যায় মিছিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। রাস্তার গলিতে ছোট মেলা আকারে বিভিন্ন খাদ্য ও খেলনা সামগ্রী ওখানে নিয়ে বসে দোকানিরা। তবে মিছিলের প্রধান সড়কের প্রায় প্রতিটি দোকানে বন্ধ ছিল।
রাজধানীর হোসনি দালান ইমামবাড়া থেকে তাজিয়া মিছিলটি ধানমন্ডি ২ নম্বর লেকপাড়ে এসে পৌঁছায় দুপুরে একটায় বলে জানান রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহেল কাফি।
তিনি বলেন, পথে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। সুসজ্জিত ভাবে মিছিলটি ইমামবাড়া থেকে মিছিল পৌঁছায়।
১০ মহররম মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের প্রতীক। হিজরি ৬১তম বর্ষের (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) এই দিনে মুসলমানদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন।
মুসলিম বিশ্বে এই দিনটি ত্যাগ ও শোকের প্রতীক। বাংলাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিশেষ করে শিয়া মুসলমানরা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করেন।
তাজিয়া মিছিলের পুরোভাগে কারবালার স্মরণে কালো চাঁদোয়ার নিচে কয়েকজন বহন করেন ইমাম হোসেনের (রা.) প্রতীকী কফিন। মিছিলের সামনে থাকে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের দুটি প্রতীকী ঘোড়া, দ্বিতীয় ঘোড়ার জিন রক্তের লালে রাঙানো।
বিগত দিনে তাজিয়া মিছিলে ছুরি, ধারালো অস্ত্রসহ যুবকদের দেখা যেত। ইমাম হোসেনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মরণে তারা নিজের শরীরে আঘাত করে নিজেকে রক্তাক্ত করতেন।
কিন্তু ২০১৫ সালে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে ইমামবাড়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে আশুরায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি বাড়ানো হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ তাজিয়া মিছিলে ধারালো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ আগেই জানিয়ে দিয়েছে, তাজিয়া মিছিলে দা, ছুরি, তলোয়ার ও লাঠিখেলা এবারও নিষিদ্ধ থাকবে। ঢাকা, ঢোল বাজিয়ে উচ্চ মাত্রার শব্দ সৃষ্টি করা যাবে না। মিছিলে নিশান বা পতাকার দণ্ড দৈর্ঘ্যে ১২ ফুটের বেশি হতে পারবে না। সার্কাসের মত আগুন খেলাও নিষিদ্ধ।
মাঝপথে যাতে কেউ মিছিলে যোগ দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীদের শনাক্ত করতে দেওয়া হয়েছে আলাদা আর্ম ব্যাজ। মিছিলে কোনো ধরনের ব্যাগ, পোঁটলা, টিফিন ক্যারিয়ার বহন না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক এমএম ফিরোজ হোসেন বলেন, সুন্দরভাবে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই মিছিলটি এসে পৌঁছেছে।
আমরা এখানে যোহরের নামাজ আদায় করবো। দোয়া দরুদ ও আমার একটি ধন্যবাদ বক্তব্য দিয়ে মিছিলের কার্যক্রম শেষ হবে। বিকেল চারটার দিকে ফরাজগঞ্জের বিবিকা রওজা থেকে আরেকটি তাজিয়া মিছিল ধানমন্ডি লেকপাড়ে আসবে বলে জানান ফিরোজ হোসেন।
আশুরা উপলক্ষে মঙ্গলবার বাংলাদেশে সরকারি ছুটি। তবে বরাবরের মত এবারও পুরান ঢাকায় আশুরার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় আগের দিন থেকেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, “মহররমের ১ তারিখ থেকে বিভিন্ন ছোট খাটো অনুষ্ঠান হচ্ছে। তখন থেকেই আমরা নিরাপত্তা বাড়িয়েছি। ৭ তারিখ থেকে বড় প্রগ্রাম শুরু হয়, আমরা সেভাবেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজিয়েছি।”
এই নিরাপত্তার অংশ হিসেবে সকাল থেকেই ইমামবাড়া থেকে ধানমণ্ডি লেক পর্যন্ত রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে আছেন পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। মিছিলের সামনে ও পেছনে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা ঢাল। বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে নজর রাখছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বকশীবাজার মোড়ে পুলিশের জলকামান ও সাজোয়া যান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সকালে ইমামবাড়ায় বলেন, “শুধু পুলিশ নয়, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও আছেন সাধারণ পোশাকে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। আয়োজকদের সঙ্গে সমন্বয় করে ভালোভাবেই সব আনুষ্ঠানিক শেষ করা যাবে বলে আশা করছি আমরা।”
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, লালবাগ, পল্টন এবং মগবাজার এলাকা থেকেও তাজিয়া মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করছেন শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসীরা। দেশের অন্যান্য জেলাতেও তাজিয়া মিছিলে চলছে শিয়া সম্প্রদায়ের শোকের পালন।
আশুরা উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, “ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। এখানে হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ বা বিভেদের কোনো স্থান নেই। ধর্মীয় উগ্রবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদসহ কুসংস্কারমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজে সত্য ও সুন্দরের আলো ছড়িয়ে দিতে পবিত্র আশুরার মহান শিক্ষা সকলের প্রেরণার উৎস হোক- এ প্রত্যাশা করি “
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, “আমি আশা করি, জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পবিত্র আশুরা হতে আমরা সকলে শিক্ষা নেব।