আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহ’র ১২৭তম তিরোধান দিবস আগামীকাল সোমবার। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়ার লালন আখড়ায় ৩ দিনব্যাপি উৎসব ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল ১৬ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এ উৎসব ও গ্রামীন মেলা।
উৎসবকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও মঞ্চ তৈরিসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন চলছে আলোক সজ্জা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ।দেশি-বিদেশী ভক্ত, দর্শনার্থী, সাধক ও আয়োজকদের নিরাপত্তা রক্ষায় এবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও ট্যুরিষ্ট পুলিশসহ চারস্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। এবারই প্রথম আমন্ত্রিত অতিথি ও দর্শনার্থীদের উৎসব স্থলের প্রবেশ গেটে মেটাল ডিকেটরের মাধ্যমে তল্লাশীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেউড়িয়ায় লালনের আখড়া বাড়ি মানেই যেনো সুর সাধনার এক অন্য পৃথিবী। বছর ঘুরে আবারো লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে সেজে উঠছে গোটা এলাকা। দূর দূরান্ত থেকে আগত লালন ভক্ত ও ফকির সাধকরা আসতে শুরু করেছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমীর সভাপতি মো. জহির রায়হান জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও সাঁইজির তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত লালন উৎসব ও মেলায় নিতে সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক ভক্ত এসেছেন। তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে উৎসবকে সফল করতে লালন একাডেমীর মূল মাজারকে আলোকসজ্জাসহ অনুষ্ঠানস্থলে মঞ্চ নির্মাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, আগত ভক্ত, বাউলদের জন্য তিন বেলা পূর্ণ সেবা, ও অধিবাসের জন্য খাবারের ব্যবস্থা এবং রাতভর লালন মঞ্চে লালন সংগীতানুষ্ঠান ও আলোচনা সভার সকল প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। একাডেমীস্থলে সকল অতিথি, দর্শনার্থীরা যাতে সহজে আসতে পারেন সে জন্য মিলপাড়া রেলগেট ও কুমারখালী দবির মোল্লার গেটে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হবে। যাতে যত্রতত্র যানবাহন চলাচল করতে না পারে।
লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী জানান, ১২৭ বছর আগে বাউল সাধক লালন শাহ দেহ ত্যাগ করেছেন। তবে তার ভক্ত ও অনুসারীরা আজও তার তীরধান দিবসটি পালন করছে। তিনি বলেন, লালনের ৩ হাজারেরও অধিক গান রয়েছে, যা সারা পৃথিবীতে মানবতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। লালনই হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি প্রথম মানবতার কথা গানের মধ্যদিয়ে প্রচার করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফকির লালন শাহকে একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক ও মহাত্মা বলে অভিহিত করে তিনি আরো বলেন, লালন তার সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার রচিত গানে তিনি একই সাথে প্রশ্ন ও উত্তর করার একটি বিশেষ শৈলী অনুসরণ করেছেন। এছাড়া তার অনেক গানে তিনি রূপকের আড়ালেও তার নানান দর্শন উপস্থাপন করেছেন।
অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসেবে লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় উল্লেখ করে এ গবেষক আরো বলেন, তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এ জন্য তাকে ‘বাউল সম্াট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় থাকে। লালন গবেষক মনে করেন, তিনি মানবতাবাদী ছিলেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে এবং এখনও করছে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের গানসমূহ উচ্চারিত হয়ে আসছে।
লালনের অসংখ্য গানগুলোর মধ্যে- ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি..’; ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে..’; ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে..’; ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়..’ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত শেষ গানটি আবার বিবিসি’র সেরা বাংলা গান জরিপে ১৪তম স্থান অর্জন করেছে।আধ্যাত্মিক এ সাধক ১৮৯০ সালের এ দিনে ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে তিনি পেটের সমস্যা ও হাত পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের বলেন- ‘আমি চলিলাম’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়।
তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হয়নি। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ি ছেউড়িয়ার আখড়ায় একটি ঘরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।