মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে জাহানারা ইমাম দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সংগ্রামের এক অনন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে আজও অবিস্মরণীয়। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আজ এই শহীদ জননীর ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম জুড়ূ। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।
মুক্তিযুদ্ধে তার ছেলে রুমী শহীদ হন, স্বামী শরিফ ইমামও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। এক সন্তান হারিয়ে সারাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে জাহানারা ইমামের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল।
শিক্ষা
জাহানারা ইমাম মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বি.এ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৬০ সালে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এম.এ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কর্মজীবন
শিক্ষক হিসাবে তার কর্মময় জীবনের প্রথম কাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১৯৫২-১৯৬০), বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক (১৯৬২-১৯৬৬)এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক (১৯৬৬-১৯৬৮) হিসাবে তার কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।
মৃত্যু
জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এর পূর্বে অসুস্থার জন্য তাকে ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয়। দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাযা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
কর্মসূচীঃ
দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ শহীদ জননীকে স্মরণ করবেন। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বিকেল ৩টায় করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আলোচনা সভা, জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
এছাড়া সকাল ৮টায় তার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। পাশাপাশি সন্ধ্যা ৬টায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভা আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।