ডিএমপি নিউজঃ ১৯৫৩ সালে তানজানিয়ায় চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে।‘চিকুনগুনিয়া’ একটি আফ্রিকান শব্দ, এর অর্থ ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাওয়া। জ্বরে হাড়ের জয়েন্টগুলি ফুলে যাওয়ার জন্য এই নামকরণ। ২০০৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়ার অস্তিত্ব ধরা পড়ে এবং ২০১১ সালে দ্বিতীয়বার সংক্রমন ঘটে । চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস একটি আলফা ভাইরাস, গোত্র টোগা ভাইরাস। এটি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস Adese aegypti মশা চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাসেরও বাহক। অন্যান্য মশার কামড়েও এ রোগের বিস্তার হতে পারে তবে তা সীমিত আকারে। তাই জ্বর হলে আতংকিত না হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার প্রভাব : ঝুঁকিপূর্ণ ২৩ এলাকা
চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঢাকার ২৩টি এলাকাকে চিহ্নিত করেছে রোগ পর্যবেক্ষণকারী সরকারের সংস্থা আইইডিসিআর। এলাকাগুলো হলো- ধানমণ্ডি ৩২, ধানমণ্ডি ৯/এ, উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়ের বাজার, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মণিপুরিপাড়া, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর-১ ও কড়াইল বস্তি।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও সাধারণ ভাইরাল জ্বরের পার্থক্য:
- একই মশা দিয়ে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর হলেও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়। চিকুনগুনিয়া হলে মৃত্যু হয় না।
- ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায় আর চিকুনগুনিয়াবাহী এডিস মশা সাধারণত ময়লা পানিতে বেশি জন্মায়।
- পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা হলে চিকুনগুনিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর মাংসপেশিতে ব্যথা হলে ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
- ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে কাঁপুনি, ঘাম ও রক্তক্ষরণ হয়। তবে চিকুনগুনিয়া জ্বরে সাধারণত এগুলো হয় না।
- চিকুনগুনিয়াতে হাত-পা ও মুখমণ্ডলে র্যাশ হয়। তবে ডেঙ্গু হলে পুরো শরীরে র্যাশ হয়।
- ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের অণুচক্রিকার সংখ্যা অনেক কমে যায়। তবে চিকুনগুনিয়ায় রক্তের অনুচক্রিকার সংখ্যা ততটা কমে না।
- একই ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু জ্বর চারবার পর্যন্ত হতে পারে। তবে চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না।
- ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া জ্বরে সাধারণত ঠান্ডা-কাশি হয় না; নাক দিয়ে পানি ঝরে না। তবে সাধারণ ভাইরাসের কারণে হওয়া জ্বরে এগুলো হয়।
- সাধারণ ভাইরাল জ্বরে তাপমাত্রা বেশি ওঠে না, শরীরে ব্যথা তুলনামূলক কম থাকে।
- চিকুনগুনিয়া জ্বরের অস্থিসন্ধির ব্যথা জ্বর কমে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে অস্থিসন্ধির ব্যথা জ্বর কমে যাওয়ার পর কমে যায়। চিকুনগুনিয়া জ্বর ভালো হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য কোনো ভাইরাল জ্বরে এতটা ভোগান্তি হয় না।
চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ কিভাবে বুঝবেন :
এ রোগের লক্ষণ হলো জ্বর, মাথাব্যথা, হাড় ব্যথা, চোখের কোটরে ব্যথা প্রভৃতি। ৩ থেকে ৫ দিনে যখন জ্বর কমতে শুরু করে তখন চুলকানি এবং লাল লাল দানা দেখা যেতে থাকে। এই রোগ ২ থেকে ৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে অনেকের দানা থাকে না। এর পরিবর্তে কালচে বাদামি বা ধূসর রঙের দানা থাকে। আবার বড়দের মতো হাড়ে ব্যথা কম সংখ্যক শিশুরই থাকে। তবে যেসব শিশুর হাড়ে ব্যথা হয় তাদের ক্ষেত্রে ব্যথার মাত্রা তীব্র হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যতিক্রম হলো মগজ বা স্নায়ুর বিভিন্ন সমস্যা, যাকে আমরা নিউরোলজিকাল লক্ষণ বলে থাকি সেগুলো শিশুদের বেশি হয়। যেমন খিচুনি, এনকেফালাইটিস। সাধারণত যে কোনো ভাইরাস জ্বর ধীরে ধীরে বাড়ে; কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত অনেক শিশুর হঠাৎ তীব্র জ্বর নিয়ে আসতে পারে।
চিকুনগুনিয়া হলে করণীয় :
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা প্রায় একই রকমের। ডেঙ্গু এন এস ওয়ান অ্যান্টিজেন বা ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে রোগনির্ণয় করতে হয়। তার আগ পর্যন্ত চিকিৎসার কোনো হেরফের নেই। সমস্যা তীব্র না হলে বাড়িতেই থাকুন। প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল পান করুন (দিনে দুই লিটার, সঙ্গে লবণ-জল, ডাবের পানি, স্যালাইন ইত্যাদি)। জ্বর ও ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল খেতে পারেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। সন্ধি ব্যথা কমাতে ঠান্ডা ছ্যাঁক নিতে পারেন, হালকা ব্যায়াম করা যায়। রোগনির্ণয়ের আগেই অ্যাসপিরিন বা ব্যথানাশক সেবন করা যাবে না।
কখন হাসপাতালে যাবেন?
এমনিতে চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর মতো জটিল না হলেও ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি বা ছোট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং কিডনি, যকৃৎ বা হৃদ্যন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ঝুঁকি থাকে। রক্তচাপ কমে গেলে বা প্রস্রাবের পরিমাণ দিনে ৫০০ মিলিলিটারের কম হলে, তিন দিন বাড়িতে চিকিৎসার পরও ব্যথা তীব্র রয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত করতে পিসিআর, কালচার বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা যেতে পারে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এ রোগে গিরার কোনো স্থায়ী ক্ষতি হয় না, এটি বাতরোগও নয়।
চিকিৎসা :
- চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ ডেঙ্গু এবং জিকার মতই। তাই চিকিৎসায় অবহেলা করা উচিত নয়।
- প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে । কোনোভাবেই অ্যাসপিরিন বা আন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবেনা ।
- পর্যাপ্ত বিশ্রামের পাশাপাশি প্রচুর পানি, ফলের রস, শরবত খেতে হবে। নাহলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা যাবে।
- সাধারণত চিকুনগুনিয়া জ্বরে রোগীর মৃত্যু হয় না। তবে নবজাতক এবং বৃদ্ধদের জন্য এই জ্বর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
- জ্বর তিনদিনের বেশি স্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।
- একবার চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়ে গেলে সারা জীবনে আর চিকুনগুনিয়া জ্বর হয় না।
চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে সতর্কতা
যেহেতু মশার কারণে রোগটি ছড়িয়ে থাকে, তাই মূল সতর্কতা হিসাবে মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচদিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নীচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে ।
যেহেতু এই মশাটি দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছোট বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পড়াতে হবে, আর সবার খেয়াল রাখতে হবে যেন মশা ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়।
প্রতিরোধ :
- এখন পযর্ন্ত চিকুনগুনিয়া কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি । জ্বর হলে এক সপ্তাহ সাবধানে থাকতে হবে যেন মশা না কামড়ায়। কারণ, মশা কামড় দিলে মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া অন্যদের দেহে ছড়াবে।
- মশা নিয়ন্ত্রণ ও ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, লম্বা হাতল-যুক্ত জামা ও ট্রাউজার পরে থাকা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেয়া ইত্যাদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু স্ত্রী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। এদের একবার রক্ত খাওয়া শেষে ডিম পাড়ার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এদের ডিমগুলো পানিতে এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
- অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম পরিসফুটনের জন্য যথেষ্ট। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুলেছে সরকার
চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখান থেকে সারা দেশে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজগুলো করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আয়োজিত এক সভায় নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত হয়। গত তিন মাসে ৬৪৩ জন ব্যক্তির রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। দেশে একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানেই চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার প্রযুক্তি আছে। সাধারণ মানুষ এটা জানে না বলে এখানে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ কম বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।
নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সারা দেশে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হবে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজগুলো করা হবে। চিকুনগুনিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এখান থেকে দেওয়া হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে সহায়তা ও গণমাধ্যমকে হালনাগাদ তথ্য দেওয়ার কাজও এই নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দেওয়া হবে।