প্রতিটি মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার ও তাঁর বান্দার হক রয়েছে। আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যেতে পারবেন না। এমন কঠোর হুশিয়ারী দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য ইসলামে কঠিন নির্দেশ রয়েছে। আত্মীয়তার বন্ধন রাখাই সৌভাগ্যের মূল এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাই দুর্ভাগ্যের মূল। এ বন্ধনের শিথিলতাই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবনতির কারণ হয়।
ইসলামিক দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি যেমন ব্যবহার করবেন এ সম্পর্কে কিছু হাদিস নিচে তুলে ধরা হল-
১. হাদিস: হজরত বাহাজ বিন হাকিম (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)কে প্রশ্ন করা হলো, কে সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য? তিনি বললেন, তোমার আম্মা। তারপর কে? তোমার আম্মা। তারপর কে? তোমার আব্বা। অতঃপর তোমার নিকটতম আত্মীয় এবং তোমার নিকটতম আত্মীয়। (তিরমিজি, আবু দাউদ)
২. হাদিস: হজরত আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুল (স.) বললেন, হে মানবগণ! শান্তি স্থাপন করো, খাদ্য প্রদান করো, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো। যখন লোক নিদ্রিত থাকে তখন রাত্রিতে নামাজ পড়, তা হলে শান্তির সঙ্গে বেহেশতে যাবে। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
৩. হাদিস: হজরত সোলায়মান বিন আমের (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলল্লাহ (স.) বলেছেন, দরিদ্রকে দান করলে এক সওয়াব এবং আত্মীয়কে দান করলে দ্বিগুন সওয়াব হয়। (দান এবং আত্মীয়তা রক্ষা) (তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ)
৪. হাদিস: হজরত মায়মুনা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি দাসিকে মুক্তি দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে ইহা ব্যক্ত করা হলে, তিনি বললেন। তুমি যদি এই অর্থ তোমার খালাকে দিতে তা তোমার অধিকতর সওয়াবের কারণ হতো। (বোখারি, মুসলিম)
৫. হাদিস: হজরত জাবের বিন সামুরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধন দেন, সে যেন প্রথমেই নিজের জন্য ও পরিজনবর্গের জন্য ব্যয় করে। (মুসলিম)।
৬. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, আল্লাহ আত্মীয়তাকে সৃষ্টি করলেন; অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার বন্ধন যে রক্ষা করে, তার বন্ধন আমি রক্ষা করি: যে ছিন্ন করে, আমি তার বন্ধন ছিন্ন করি। (বোখারি, মুসলিম)।
৭. হাদিস: হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, রেহেম হতে রহমের (দয়ার) উৎপত্তি। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে তোমার মন করে, আমিও তার বন্ধন রক্ষা করি এবং যে তোমার বন্ধন ছিন্ন করে, আমি বন্ধন ছিন্ন করি।’ (বোখারি)।
৮. হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসুল (স.) কে জিজ্ঞেস করল, আমার আত্মীয়স্বজন রয়েছে, তাদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে চাই, কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের প্রতি সদয়, কিন্তু তারা আমার প্রতি নির্দয়। তিনি বললেন, তুমি যেরূপ বলো, তারা যদি তাই করে, তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত অঙ্গারের বটিকা দিতেছ এবং তুমি যতদিন এরূপ ব্যবহার কর ততদিন আল্লাহ হতে তোমার সঙ্গে অনবরত একজন সাহায্যকারী থাকবে। (মুসলিম)
৯. হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তোমাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কিরূপে আত্মীয়তার বন্ধন রাখতে হয়, তা তোমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে হতে শিক্ষালাভ করো, কেননা আত্মীয়তার বন্ধন পরিবারের মধ্যে ভালোবাসার উপায়, ধর্ম বৃদ্ধির উপকরণ এবং মৃত্যু বিলম্ব করার উপায়। (তিরমিজি)
১০. হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.) কে বলল, আমার একটি দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) আছে। তিনি বললেন, তোমার নিজের জন্য ব্যয় কর। সে বলল, আমার আর একটি দিনার আছে। তিনি বললেন, তোমার সন্তানগণের জন্য তা ব্যয় কর। সে বলল, আমার আর একটি দিনার আছে। তিনি বললেন, তা তোমার স্ত্রীর জন্য ব্যয় কর। সে বলল, আমার আর একটি দিনার আছে। তিনি বললেন, তা তোমার দাস বা খাদেমের জন্য ব্যয় কর। সে বলল, আমার আর একটি দিনার আছে তিনি বললেন, তুমিই এর ব্যয় সম্বন্ধে উত্তম জ্ঞাত আছ। (আবু দাউদ, নাসায়ি)
১১. হাদিস: হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বললেন. রেহেম আরশের সঙ্গে এ বলে ঝুলতেছে, যে আমার সঙ্গে বন্ধন রাখে, আল্লাহ তার সঙ্গে বন্ধন রাখেন এবং যে আমাকে কর্তন করে ফেলে, তিনি তার সঙ্গে বন্ধন কর্তন করে ফেলেন। (বোখারি, মুসলিম)
১২. হাদিস: হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুল (স.) বলেছেন, যে ইচ্ছা করে যে, তার উপার্জন বৃদ্ধি হউক এবং তার মৃত্যু বিলম্বে হক, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (বোখারি, মুসলিম)
১৩. হাদিস: হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত আবু তালহা আনসারদের মধ্যে খেজুরের সম্পদে সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন। মসজিদের সম্মুখের বিরহা উদ্যানটি তার কাছে অধিক প্রিয় ছিল। রাসুলুল্লাহ (স.) উক্ত উদ্যানে প্রবেশ করে বিশুদ্ধ পানি পান করতেন। যখন এই আয়াতটি নাজিল হলো, ‘তোমরা যা ভালোবাস, তা ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কিছুতেই ধর্ম অর্জন করতে পারবে না।’ আবু তালহা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললেন, আমার ধন-সম্পত্তির মধ্যে বিরহা উদ্যানকে আমি অধিক প্রিয় মনে করি। মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমি তা দান করলাম। এর পুরস্কার আমি আল্লাহর কাছে আশা করি। আল্লাহর নির্দেশানুসারে একে ব্যয় করুন। হজরত বললেন, ধন্য, ধন্য। এটা মূল্যবান সম্পত্তি। তুমি যা বলেছ, শুনেছি। আশা করি, তোমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তুমি তা বণ্টন করে দাও। আবু তালহা তার আত্মীয়স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। (বোখারি, মুসলিম)
১৪. হাদিস: হজরত আমর বিন আস (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার পিতার পরিবার আমার প্রতি প্রীতিভাবাপন্ন নয়। আমার বন্ধু আল্লাহ এবং মুমিনদের ভেতর ধার্মিক ব্যক্তি। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে আত্মীয়তা আছে, তা আমি হূদ্যতার সঙ্গে রক্ষা করব। (বোখারি, মুসলিম)
১৫. হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) হতে বণিত। তিনি বলেন, কোন দান সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, জিজ্ঞাসিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, দরিদ্রকে দান। আত্মীয়কে প্রথম দান করো। (আবু দাউদ)
১৬. হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুল (স.) বলেছেন, যে অর্থ তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করো, যে অর্থ দাস-দাসির মুক্তিতে ব্যয় করো, যে অর্থ দরিদ্রের জন্য ব্যয় করো, যে অর্থ পরিবারের জন্য ব্যয় করো, সর্বাপেক্ষা অধিক সওয়াব এ অর্থের যা তুমি পরিবারের জন্য ব্যয় করো। (মুসলিম)
১৭. হাদিস: হজরত জাবের বিন মোতয়েম (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ বলেন, যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, সে বেহেশতে যাবে না। (বোখারি, মুসলিম)
১৮. হাদিস: হজরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চললেই যথেষ্ট হবে না। একবার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেলে পুনরায় তা সংযোগ করাই প্রকৃত স্বজনপ্রীতি। (বোখারি)
১৯. হাদিস: হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি রহমান। আমি রহম (আত্মীয়তার বন্ধন) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম হতে তা বের করেছি। যে তার বন্ধন রাখে, আমিও তার বন্ধন রাখব এবং যে তা কর্তন করে, আমি তাকে ধ্বংস করব।’ (আবু দাউদ)
২০. হাদিস: হজরত আবু বাকরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, বিদ্রোহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ব্যতীত আর অন্য কোনো গোনাহ নেই, যার জন্য আখিরাতে শাস্তি অবধারিত থাকে। তা সত্ত্বেও এ পৃথিবীতে তার শাস্তি হয়। (আবু দাউদ) তথ্যসূত্রঃঅনলাইন