ডিএমপি নিউজঃ সুখে-শান্তিতেই থাকতে চেয়েছিল মেয়েটি। ঘরও বেঁধেছিল একজনের সাথে। কিন্তু শান্তির সুবাতাস একদিন বিদ্রোহ করে বসে। শুরু হয় ঝড়ো বাতাস। এই বাতাসে টালমাটাল হয়ে যায় সবকিছু। যাপিত জীবনের সরলরেখার মতো আলোক রেখাটা একদিন আয়তাকার অন্ধকার গলিতেই এসে ঠেকে যায়। শুরু হয় সান্ধ্যকালীন জীবীকা। অন্ধকার জীবনে অভ্যস্ত হওয়া খুব কঠিন কাজ। মনের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করেই শারমিন একদিন বের হয়ে আসারও চেষ্টা করে ওই পথ থেকে। মে মাসের শেষদিকে মাস্ক তৈরির একটি কারখানায় কাজ নেয়। হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচে। কলিজার টুকরো তিন বছরের মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে শুরু হয় সুস্থ-সুন্দর জীবনের পথচলা।
কিন্তু লোভ যে বড় খারাপ জিনিস। লোভকে সংবরণ করতে শিখতে হয়, নাহলে লোভ সুযোগ বুঝে ছোবল মারে। কিন্তু সেদিন কি তাহলে লোভে পড়ে মেয়েটি ঐ নির্জন স্থানে গিয়েছিল নাকি নতুন জীবনের জন্য সকল পাপের বোঝাপড়া মোচন করতে গিয়েছিল? চলুন ঘটনার ভেতরে যাই ধীরে ধীরে।
শ্যামল বরণ মেয়েটির শ্যামল ঘেরা কুটিরে শতশত স্বপ্ন থাকা স্বত্ত্বেও জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে কোন এক গাঁয়ের বধূর যে গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন গানের সেই মেয়েটির কাহিনী ছিল শিশিরে ভেজা কিন্তু শারমিন নামের যে মেয়েটির গল্প আজ বলবো তা শিশিরে নয় বরং রক্তে ভেজা, সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে হীম হয়ে যাওয়া একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অজ্ঞাত লাশের গল্প।
উত্তরা বিভাগের উত্তরখান থানা এলাকার বৈকাল রোডের একটি নির্জন স্থানে গত শুক্রবার পাঁচ জুন রাতেই সলিল সমাধি ঘটে এই শারমিনের। মানুষ নামের চারজন অমানুষ, নরপশু পালাক্রমে ধর্ষণ করে ধারালো চাপাতি দিয়ে গলার একপাশ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। শনিবার সকালে খবর পেয়ে ছুটে আসে উত্তরখান থানা পুলিশ। খবর দেওয়া হয় সিআইডির ক্রাইম সিনকে। লাশের সুরতহাল সম্পন্ন করে লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢামেক মর্গে। বিকেলেই আমাদের ডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল স্যারের পরামর্শে পিবিআইর মাধ্যমেও আঙুলের ছাপ নেওয়ার ব্যবস্থা করি। একসময় লাশের পরিচয় মেলে। মেয়েটির বাবা কোন এক মাধ্যমে খবর পেয়ে মর্গে গিয়ে নিজের মেয়ের লাশ সনাক্ত করেন। ঘটনা মোড় নেয় এখানেই। তদন্তে আলো আসতে শুরু করে। আমরা আশান্বিত হতে থাকি।
চলুন এবার মূল ঘটনায় যাওয়া যাক-
উত্তরখানের সিদ্ধিরটেক এলাকা। এখানেই হাজী মাহাতবের ভাড়া বাড়িতে পাশাপাশি রুমে চারটি পরিবার ভাড়া থাকে। ভিকটিম শারমিন তার বাবা-মা আর একমাত্র মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে ছিল এখানেই। একসময় পাশের রুমের বিবাহিত ফুরকানের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে শারমিনের; তা একসময় অবৈধ মেলামেশায় রূপ নেয়। পরে ফুরকান জানতে পারে শারমিন টাকার বিনিময়ে আরো অনেকের সাথেই এভাবে মেলামেশা করে। এতে ভেতরে-ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে থাকে সে।একদিন কাছের সহকর্মী মাসুদের মাধ্যমে ফুরকান জানতে পারে মাসুদ আর শারমিনের সম্পর্কের কথা।
এই মাসুদকে শারমিনের সাথে ফুরকানই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। অথচ তারা ফুরকানের অজান্তেই জড়িয়েছে অবৈধ মেলামেশায়। মাসুদকে ফুরকান কিছু বলতে পারেনা, কারণ মাসুদ ছিল মাস্টারমাইন্ড টাইপের একজন ভয়ংকর ক্রিমিনাল। কিন্তু গত শুক্রবার সকালে মাসুদ অনেক অভিযোগ নিয়ে আসে ফুরকানের কাছে। ফুরকানসহ আরো অনেকের কাছেই টাকা নিয়ে তাদের ডাকে নাকি সাড়া দেয়নি শারমিন। মাসুদ, ফুরকানের মতো এরকম আরো দুজন ভিড়ে যায় ওই দলে। সবার অভিযোগ অগ্রীম টাকা নিয়ে সাড়া দেয়নি মেয়েটি। চারজনের রাগ এক হয়ে ক্ষোভের বোম তৈরি হয় ওদের মনে। মেয়েটিকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একমত হয় সবাই। তবে তাকে চিরতরে মেরে ফেলার জন্য চারজনের সবাই প্রস্তুত ছিল কিনা এটি প্রাথমিকভাবে সন্দেহের উদ্রেক করলেও কিন্তু ঘটনার আগেও ঘটনা থাকে, যেটাকে ঘটনার পরম্পরা বলে। চলুন সেই পরম্পরায়..
প্ল্যান অনুযায়ী পাঁচ জুন শুক্রবার বিকেলে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে খুব হাসিমুখে শারমিনের সাথে কথা বলতে থাকে ফুরকান।শারমিনের সাথে খুব ভালো একটা আলাপ আছে বলে সন্ধ্যা সাতটার পরে গেটের বাইরে দেখা করতে বলে। শারমিন সময় মতো বাইরে বের হয়ে আসে। ফুরকানের সাথে ধীরে ধীরে সামনে হাঁটতে থাকে। একটু দূরে মাসুদকে দেখে চমকে উঠে শারমিন। মাসুদ সরাসরি টাকা নিয়ে ঘুরানোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে শারমিন চুপ থাকে। একটু পরে যোগ দেয় সাইফুল ও আনোয়ার। তারা সবাই খারাপ কাজে রাজী করাতে থাকে শারমিনকে। কি মনে করে শারমিন রাজী হয়ে যায়। শারমিনসহ চারজন ঢুকে বৈকাল রোডের একটি নির্জন জায়গায়। মাসুদ চারজনের হিসেবে সাড়ে তিনহাজার টাকা তুলে দেয় শারমিনের হাতে।
একে একে সবাই রেইপ করে। শেষে হুট করে শারমিনের হাত দুটো ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলে মাসুদ। এতে শারমিন বেশ হচকচিয়ে যায়। টাকা-পয়সা নিয়ে ঘুরানোর বিষয়ে তর্ক শুরু হয়। শারমিন মাস্ক তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছে এবং এসব বাজে কাজ ছেড়ে দিয়েছে বলে জানালে ওরা আরো ক্ষিপ্ত হয়। সকাল হলে এই কাহিনী সবাইকে বলে দিবে জানালে চারজনেই তেলে-বেগুণে জ্বলে উঠে। মাসুদের হুকুমে এক পর্যায়ে ফুরকান হাত ও মুখ চেপে ধরে আর সাইফুল ও আনোয়ার চিপে ধরে পা দু’টো। তার আগে সাড়ে তিনহাজার টাকা কেড়ে নেয় মাসুদ। পরে কোমর থেকে ধারালো চাপাতি চালিয়ে দেয় শারমিনের গলায়। রক্ত যাতে না ছিটকে পড়ে সেজন্য সালোয়ার দিয়ে বেশ কয়েকটি প্যাঁচ দেয় গলার মধ্যে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসে শারমিনের নিথর দেহ। চাপাতির আঘাতে শারমিনের স্বপ্ন, নতুন করে বাঁচতে চাওয়া, মেয়ে কুলসুমের আদরমাখা মুখ সবকিছুই উড়ে যায় নিমিষেই।
ডিসি উত্তরা নাবিদ কামাল শৈবাল স্যারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রাত-দিন পরিশ্রম করে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে জামালপুরের বকশিগঞ্জ থেকে ফুরকান ও উত্তরখানের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাসুদ, সাইফুল ও আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। এক্ষেত্রে ডিএমপির আইএডি বিভাগ নিরবচ্ছিন্নভাবে দারুণ সহায়তা করেছে আমাদের। দু’জন আসামী আজ বিজ্ঞ আদালতে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে তাদের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করেছে।
(লেখাটি এডিসি দক্ষিণখান জোন এ.এস.এম হাফিজুর রহমান রিয়েল এর ফেইসবুক পেইজ থেকে ডিএমপি নিউজের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো। )