সৌদি আরবের স্বেচ্ছানির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগির অন্তর্ধান ও কথিত হত্যাকাণ্ডে তোলপাড় শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। জোরেশোরে অভিযোগ উঠেছে, ভিসা সংক্রান্ত কাজে তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেট কার্যালয়ে প্রবেশ করলে তাকে হত্যা করে একটি বিশেষ ঘাতক দল। এই ঘটনা পশ্চিমের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এমনকি নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। কিন্তু কে এই জামাল খাসোগি?
আল-জাজিরার এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সৌদি আরব ও আরব বিশ্বে নিজের প্রজন্মের সবচেয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একজন তিনি। প্রায় ৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত তিনি। ১৯৫৮ সালে সৌদি আরবের মদিনায় জন্ম তার। একসময় তিনি সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতাবৃত্তের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। রাজপরিবারে সংস্কারবাদী হিসেবে তার সুনাম ছিল।
সৌদি আরবের আঞ্চলিক ও ঘরোয়া অনেক নীতিমালার সমালোচনাও করতেন তিনি। যুবা বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়েন তিনি। এরপর ইংরেজি ভাষার সৌদি গেজেট পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি লন্ডনভিত্তিক সৌদি মালিকানাধীন আশারক আল-আওসাতের প্রতিনিধি ছিলেন। এছাড়া আরব দুনিয়ায় বহুল পরিচিত আল হায়াত পত্রিকায় ৮ বছর কাজ করেন তিনি।
তবে খাসোগি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, কুয়েত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সংবাদ করার কারণে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তিনি বেশ কয়েকবার ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেন। তখনও বিন লাদেন আল কায়েদার প্রধান হননি।১৯৯৯ সালে সৌদি আরবের বিখ্যাত পত্রিকা আরব নিউজের উপ-সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। চার বছর সেখান থেকে তিনি আল ওয়াতান পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের পদ পান। তবে ২০০৩ সালে মাত্র দুই মাসের মাথায় কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তাকে বরখাস্ত করা হয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন, তার গৃহীত ‘সম্পাদকীয় নীতি’ই ছিল এর কারণ।
এরপর তিনি সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থা জেনারেল ইন্টিলিজেন্স ডিরেক্টরেটের প্রধান প্রিন্স তুরকি বিন ফয়সালের গণমাধ্যম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। এরপর ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি ফের আল ওয়াতান পত্রিকার সম্পাদক হন। কিন্তু ২০১০ সালে তাকে ফের বরখাস্ত করা হয়। নিজের ওয়েবসাইটে খাসোগি লিখেছেন, ‘সৌদি সমাজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কে’ উৎসাহ দেয়ার কারণেই ওই খড়গ নেমে আসে।
ওই বছরই অবশ্য তিনি আল আরব নিউজ চ্যানেলের জেনারেল ম্যানেজার পদে নিয়োগ পান। এই চ্যানেলের মালিক ছিলেন প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল। এটি পরিচালিত হতো বাহরাইনের মানামা থেকে। কিন্তু ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরুর মাত্র একদিনের মাথায় ওই চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে অনুমান করেছিলেন, চ্যানেলটির সম্পাদকীয় নীতিমালা ও বাহরাইনের বিরোধীদলীয় এক নেতাকে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোকে কেন্দ্র করে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
এসবের বাইরেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে সৌদি ও আরব চ্যানেলগুলোতে প্রায়ই কথা বলতেন খাসোগি।বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যদিয়ে গেলেও পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানের সময়টায়। খাসোগি এ সময় যুবরাজের বিভিন্ন ঘরোয়া নীতির সমালোচনা করেন। বিশেষ করে, যুবরাজের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভিন্নমতালম্বীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে খাসোগি সরব ছিলেন।
মূলত, ক্ষমতায় এসেই বিরাট আকারে দমনপীড়ন শুরু করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। আটক করেন অন্য রাজপরিবারের বহু সদস্য, প্রখ্যাত ব্যবসায়ী, অ্যাক্টিভিস্ট ও ধর্মীয় নেতাদের। খাসোগি তখনও লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। নিজ দেশে বাকস্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য দেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সৌদি আরবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্তির সমালোচনা করেন।
টুইটারে দেয়া এক পোস্টে তিনি লিখেন, বেশ অনেক দিন ধরে আমি দেখতে পাচ্ছি যে, যারাই সংস্কার, পরিবর্তন, আরব বসন্ত ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এবং যারা তাদের ধর্ম ও দেশ নিয়ে গর্বিত, তাদেরকে মুসলিম ব্রাদারহুড বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। মনে তো হচ্ছে, ব্রাদারহুডের চিন্তাচেতনা বেশ মঙ্গলদায়ক। তার এই অকপট কথাবার্তার দরুন সৌদি আরবে তার অবস্থান বেশ সংকটে পতিত হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ওয়াশিংটনে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি বলেন, তাকে ‘চুপ থাকার নির্দেশ’ দেয়া হয়েছে।
ওই মাসেই তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি কলাম লিখেন, যার শিরোনাম: ‘সৌদি আরব সবসময়ই এতটা নিপীড়নমূলক ছিল না। এখন এটি অসহনীয়।’ তিনি টুইটারে আর্টিকেলটি শেয়ার করে লিখেন, আমি ওয়াশিংটন পোস্টে এই লেখাটি প্রকাশ করে খুশি নই। কিন্তু নীরব থাকাটাও আমার দেশ কিংবা বন্দিদের প্রতি সহায়ক নয়। তার এই নিবন্ধের সমালোচনা করেন মক্কা প্রদেশের গভর্নর প্রিন্স খালেদ আল সৌদ। তিনি টুইটারে লিখেন, আপনার বা আপনাদের মতো কারও কাছ থেকে পরামর্শ দরকার নেই আমাদের বিজ্ঞ নেতৃবৃন্দের।
কয়েক মাস পরেই ডিসেম্বরে আল হায়াত পত্রিকা খাসোগির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে। তার নিবন্ধ বন্ধ করে দেয়া হয়। সৌদি আরবের প্রতি তার ‘সীমা লঙ্ঘন’কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে পত্রিকাটি। ওয়াশিংটনে থাকাকালে খাসোগি স্বাধীনতা ও অধিকারের স্বপক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় তিনি মতামত সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর খাসোগি সৌদি যুবরাজের সমালোচনা আরও বাড়িয়ে দেন। তাকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তুলনা করেন।
২১শে মে’তে তিনি এক কলামে লিখেন, ‘আমাদের কাছ থেকে আশা করা হয় আমরা সামাজিক সংস্কারের প্রশংসা করবো। যুবরাজের প্রশংসা করবো। কিন্তু কয়েক দশক আগে যেসব সৌদি অগ্রদূত এসব নিয়ে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে কোনো অবতারণাই করবো না।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমাদেরকে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যেকোনো আশা পরিত্যাগ করতে। এছাড়া সমালোচক ও তাদের পরিবারের ওপর যে দমনপীড়ন, গ্রেপ্তার ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ হচ্ছে তা নিয়ে চুপ থাকতে।’