মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঘা মসজিদটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ গুলির অন্যতম। বাঘা মসজিদ রাজশাহী জেলা সদর হতে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাস:
মসজিদটি ১৫২৩-১৫২৪ সালে (৯৩০ হিজরি) হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নুসরাত শাহ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয়।
নামকরণ:
নাম করণের তেমন কোনো ইতিহাস জানা যায় না। যেহেতু এটি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায় অবস্থিত সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি ওই নামানুসারে এটার নাম হচ্ছে বাঘা মসজিদ। মূলত এটি বাংলাদেশের অন্যান্য শাহী আমলের মসজিদের মতোই একটি শাহী মসজিদ। বাংলাদেশের ৫০ টাকার নোট আর ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটে দেখা যায় প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন শাহি মসজিদটি ।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য:
মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভুমি থেকে থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে । আর ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব রয়েছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত। দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে। ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর দেয়াল ২.২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০টি গম্বুজ, ৪টি মিনার (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মসজিদটি চারদিক হতে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীরের দু’দিকে দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের ভিতরে-বাইরে সবর্ত্রই টেরাকোটার নকশা বর্তমান। সবখানেই টেরাকোটার নকশা।
বিবরণ:
বাঘা মসজিদটির গাঁথুনি চুন এবং সুরকি দিয়ে। মসজিদের ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে সুন্দর মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া আছে পোড়ামাটির অসংখ্য কারুকাজ যার ভেতরে রয়েছে আমগাছ, শাপলা ফুল, লতাপাতাসহ ফার্সি খোদাই শিল্পে ব্যবহৃত হাজার রকম কারুকাজ। এছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তর পাশেই রয়েছে হজরত শাহদৌলা ও তার পাঁচ সঙ্গীর মাজার। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহর পুত্র নাসিরউদ্দীন নসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই একটি দিঘী খনন করেন।
শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দিঘিটি ৫২ বিঘা জমির ওপর রয়েছে। এই দিঘির চারপাশে রয়েছে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ। প্রতিবছর শীতের সময় এ দিঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে দিঘিটির চারটি বাঁধানো পাড় নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাজার রয়েছে। মূল মাজারের উত্তর পাশে রয়েছে তার কবর। এ ছাড়া মসজিদ সংলগ্ন মাটির নিচ থেকে মহল পুকুর আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খনন কাজের ফলে ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মেলেছে। এই পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে বাঁধানো সিঁড়ির ভেতরে নেমে গেছে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে প্রচুর পোড়ামাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত একটি বিশেষ নামাজের কক্ষ আছে। এ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ৩ দিন পর্যন্ত ‘বাঘার মেলা’র আয়োজন করা হয়। এ মেলাটি ৫০০ বছরের ঐতিহ্য।
কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে রাজশাহী যাওয়া যায়। দুই ভাবে আপনি বাঘা মসজিদ যেতে পারবেন। নাটোর থেকে ও রাজশাহী থেকে। দূরত্ব উভয়দিক থেকে প্রায় সমানই।
নাটোর থেকে গেলে আপনি প্রথমে পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ড যাবেন। ভাড়া পড়বে ৪০-৫০ টাকা। পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ড এর পাশেই পুঠিয়া রাজবাড়ী। ওটাও ইচ্ছে করলে দেখে ওখান থেকে অটো অথবা সিএনজি করে সোজা বাঘা শাহী মসজিদ এ যেতে পারবেন ভাড়া পড়বে ১৫০-২০০ টাকা।
ঢাকা থেকে নাটোর চার ঘণ্টার পথ। গ্রিনলাইন ও হানিফ পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসসহ শ্যামলী ও ন্যাশনাল ট্রাভেলসের বাস এ পথে নিয়মিত চলাচল করে। এ ছাড়া রাজশাহী গামী যে কোন বাসে অথবা ট্রেনে নাটোর যাওয়া যাবে।
আর রাজশাহী থেকে বাঘা যাওয়ার সহজ উপায় হল বাস। রাজশাহী শিরইল বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঘার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে দেশ ট্রাভেলস ও গ্রীন লাইন পরিবহনের এসি বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। এছাড়া ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যমলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, বাবলু এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বাস যায় রাজশাহী।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউনাইটেড এয়ারের বিমান চলাচল করে রাজশাহীতে।
কোথায় থাকবেন:
যদি নাটোর থেকে যান তাহলে নাটোরে রাতে থাকার জন্য ভিআইপি হোটেলের কোনো বিকল্প নেই। কাছাকাছি মানের হোটেল আরপিতেও নির্দ্বিধায় রাত যাপন করতে পারেন। থাকতে পারেন হোটেল মিল্লাতেও। এছাড়া সাধারন মানের হোটেলের মধ্যে আরও আছে – হোটেল রুখসানা (কানাইখালিতে অবস্থিত), হোটেল উত্তরা ফকির হাটের।
আর যদি রাজশাহী থেকে যান তাহলে রাজশাহী শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। রাজশাহী শহরের অন্যান্য হোটেলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল ,শিরোইলে হোটেল হকস্ ইন্ ,সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল ওবিন্দুর মোড়ে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল।