রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ নিয়ে দেশটিকে কঠোর বার্তা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। মূল এজেন্ডায় না থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার তরফ থেকে এরই মধ্যে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, গতকাল সোমবার শুরু হওয়া জাতিসংঘের অধিবেশন ও সাইডলাইন বৈঠকগুলোতে বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সোচ্চার হবে। হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণ, নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার যাতে নাগরিক অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে নেয়, সে জন্য জাতিসংঘে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বনেতাদের চাপ ও সমালোচনার ভয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি অধিবেশনে যোগ দেওয়া থেকেই বিরত রয়েছেন।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গতকাল বাংলাদেশ সময় রাতে শুরু হওয়া ৭২তম সাধারণ অধিবেশন চলবে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এতে ১৯৩টি দেশ অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যোগ দিয়েছেন সম্মেলনে। বাকি দেশগুলোর পক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীরা অংশ নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবারই প্রথম যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে এই দুই নেতার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে। এ ছাড়া চীন ও রাশিয়ার মনোভাব পরিবর্তনেও কাজ করবেন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা।
এবারের অধিবেশনে নির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে নেই উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ কিংবা রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের জাতিগত শুদ্ধি অভিযান। তবে অধিবেশনে এ দুটি ইস্যুই আলোচনার মূল কেন্দ্রে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ৯ বছরের মধ্যে এবারই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির ওপর চাপ দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকবে জাতিসংঘে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে মিয়ানমারকে।
অধিবেশনে ২১ সেপ্টেম্বর মাতৃভাষায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যেখানে তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান জাতিগত নিধনের বর্ণনা দিয়ে এ সংকটের স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে সব দেশকে আহ্বান জানাবেন। তিনি মূল অধিবেশনের বাইরে সাইডলাইনে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন মিয়ানমারের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সময় রোহিঙ্গা বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। ১৯ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ওআইসির রোহিঙ্গাবিষয়ক যোগাযোগ গ্রুপের একটি উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্টসহ ওআইসি দেশগুলোর নেতারা এতে অংশ নেবেন।
গতকাল সোমবার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অধিবেশনের সাইডলাইনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেকও সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারকে অবশ্যই ফেরত নিতে হবে। ঢাকা সফররত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্যিক দূত রুশনারা আলীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহিরয়ার আলম। বৈঠকে রুশনারা আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর এ নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়।
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেছেন, মিয়ানমার সরকারের অভিযান মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্যই পরিচালিত হচ্ছে। কানাডা সরকার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনায় কানাডা খুবই উদ্বিগ্ন এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুড্রো রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলবেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে বলেও জানান তিনি। এর আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংকট সমাধানে সুচির প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে সাইডলাইন বৈঠক করবে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাধারণ অধিবেশনে যাননি, সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ভারতও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে সুষমা স্বরাজ কয়েক দিন আগেই টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে জাতিসংঘে সোচ্চার হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রোহিঙ্গা নিয়ে অধিবেশনকালে একটি গ্রুপ বৈঠকও করবেন তিনি, যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা থাকবেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এরই মধ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থামানোর এখনই শেষ সুযোগ দেশটির নেত্রী অং সান সুচির সামনে। না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
‘এ বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আমরা কী কী দেখতে পারি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে গত রবিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস জাতিসংঘে ট্রাম্পের প্রভাব ও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টির পরই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাকে উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস ও শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাকে একটি জাতিকে নিধন ও নির্মূল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রতিদিনই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বনেতারা কী বলবেন? শক্তিশালী নিরাপত্তা পরিষদ কি এই হত্যাকাণ্ড থামাতে পারবে, মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে দ্রুত এ সংকটের সমাধান করতে পারবে?’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের মূল সমর্থক চীন রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক অভিযান পরিচালনা বন্ধে বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান শিথিল করেছে। সোমবার মিয়ানমার ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন অন্যান্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম ওয়ার্ল্ড ট্রিবিউনডটকম বলেছে, জাতিসংঘের অধিবেশনে উত্তর কোরিয়া সংকটই একমাত্র আলোচ্য বিষয় নয়, চীনের সমর্থনে মিয়ানমারে জাতিগত হত্যাকাণ্ডও বিবেচনায় আসছে। অনলাইনটি প্রশ্ন তুলে বলেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সামরিক বাহিনীর চলমান নিধনযজ্ঞ ও চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার মতো ঘটনাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাইডলাইনে করতে হচ্ছে কেন? এ জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে চীনের দেওয়া অব্যাহত সমর্থনকে দায়ী করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার আগে এক বিবৃতিতে বলেছেন, অধিবেশনের ভেতরে ও বাইরে তিনি রোহিঙ্গা নিধন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে সরব হওয়ার কথা বলেছে ইন্দোনেশিয়াও।সূত্রঃ কালেরকন্ঠ।