শখের বসে মানুষ কতই না কি করে?কেউ বা বাস করে কবরে, কেউ বা গুহায় অথবা মৃত আগ্নেয়গিরিতে জনবসতি গড়ে তোলার উদাহরণ তো কতই আছে। তাই বলে জীবন্ত এক আগ্নেয়গিরিতে বসবাস করার কথা কেউ ভাবতে পারে! এমন একটা জনপদ কিন্তু সত্যিই আছে জাপানে।
টোকিও থেকে দক্ষিণে ফিলিপাইন সাগর ধরে এগিয়ে গেলে ডজনখানেক ছোট আগ্নেয়দ্বীপ পড়ে। এই দ্বীপগুলো থেকে আরেকটু পশ্চিমে গেলেই প্রশান্ত মহাসাগর। এই দ্বীপগুলোকে বলা হয় ইজু দ্বীপপুঞ্জ। আগে বোধ হয় ধারণা করা হতো, ওখানে সব মিলিয়ে দ্বীপ আছে সাতটি। তাই দ্বীপগুলো পরিচিত ছিল ‘ইজু শিচিতো’ নামে, মানে ‘সপ্তইজু’। এই ইজু শিচিতোরই একটি দ্বীপ ওগাশিমা। দ্বীপটি মূলত একটি আগ্নেয়গিরি। তার অগ্ন্যুৎপাতে নির্গত হওয়া লাভা জমাট বেঁধে তৈরি হয়েছে দ্বীপটি। আকারেও খুব একটা বড় নয়; দৈর্ঘ্যে সাড়ে তিন কিলোমিটার, আর প্রস্থে আড়াই কিলোমিটার। তবে দ্বীপটিতে মানুষ বাস করছে কয়েক শ বছর ধরে।
ঠিক কবে এখানে মানুষ বাস করতে শুরু করেছে, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তবে জাপানের ইদো যুগের (১৬০৩-১৮৬৮) নথিপত্রে ওগাশিমায় মানুষ বাস করার খবর পাওয়া যায়। সেই নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৬৫২, ১৬৭০-৮০ এবং ১৭৮০-৮৫ সালে ওগাশিমায় অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিল।
শেষবারের অগ্ন্যুৎপাতে, মানে ১৭৮৫ সালে দ্বীপটির সোয়া তিন শ অধিবাসীর প্রায় অর্ধেকই মারা পড়ে। বাকিদেরও দ্বীপ ছেড়ে চলে আসতে হয়। তার পরও ওগাশিমার মানুষরা তাদের জন্মভূমি এই দ্বীপ পরিত্যাগ করেনি। ৫০ বছর যেতে না-যেতেই তারা আবার এই জীবন্ত আগ্নেয়গিরিটিতে এসে বসতি গাড়তে শুরু করে।
অমন একটা জ্যান্ত আগ্নেয়গিরি বসতি গাড়ার জন্য ভীষণই ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দ্বীপটিতে বাস করছেন শ দুয়েক অধিবাসী। নির্দিষ্ট করে বললে, ২০০৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ওগাশিমার বর্তমান জনসংখ্যা ২০৫ জন। তারা অবশ্য পুরো দ্বীপটিতে নয় বরং দ্বীপের ছোট্ট একটি অংশেই বসবাস করে।
দ্বীপের যত নাগরিক সুবিধা—একটি স্কুল, একটি পোস্ট অফিস ও একটি মুদি দোকান, সে সবও এই অঞ্চলেই অবস্থিত। কারণও আছে। আগ্নেয়গিরিটি যে এখনো জীবন্ত। দ্বীপের ভেতরের দিকে গেলে সেই জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উত্তাপও ভালোই অনুভব করা যায়। ওই গরম অঞ্চলে সাগরের পানি শুকিয়ে লবণও বানানো হয়। বলা হয়, এইভাবে প্রস্তুতকৃত লবণ নাকি শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী। দ্বীপের লোকদের আয়ের উৎস এই লবণ আর পর্যটন শিল্প।
অমন একটি জ্যান্ত আগ্নেয়গিরি বসতি গাড়ার জন্য যতটা ঝুঁকিপূর্ণ, ঘুরতে যাওয়ার জন্য ততটা নয়। আর তা ছাড়া ওইটুকু ঝুঁকি নেওয়ার মতো অনেক উপাদানই আছে ওখানে। একে তো দ্বীপটির ধরনই যেকোনো পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয়, উপরন্তু একটি জ্যান্ত আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে আস্ত একটি জনবসতি। আকর্ষণ আছে আরো—ঠিক মাঝখানে পুরো দ্বীপটির মতোই দেখতে ছোট আরেকটি ভূমিকাঠামো আছে।
ওটাই মূলত আগ্নেয়গিরির মুখ। আগ্নেয়গিরির ভেতর থেকে একটি ফুটন্ত গরম পানির ধারা সেখান দিয়ে অনবরত বের হচ্ছে। সে পানি এতটাই গরম যে রান্নার কাজও চালিয়ে নেওয়া যায়। সেই ফুটন্ত গরম পানির ঝরনা দিয়ে করা হয়েছে প্রাকৃতিক সনা গোসলের ব্যবস্থা। দ্বীপের পাহাড়ি উঁচু-নিচু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই সনা গোসল করার পর শরীরের সব ক্লান্তিই যেন দূর হয়ে যায়।
দ্বীপের এই পাহাড়ি পথই পর্যটকদের কাছে আরেক আকর্ষণ। এমনিতে জাপান ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর দেশ। প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে এই দ্বীপটিতেও, তবে আগ্নেয়গিরি পর্যন্ত যেতে হয় পাহাড়িপথে হাইকিং করে। সে হাইকিংয়ের ট্রেইল বা চলার পথে দুই চোখ ভরে উপভোগ করা যায় সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাশাপাশি ক্যাম্পিংও করা যায়। আছে স্কুবা ডাইভিংয়ের ব্যবস্থাও। আর ওখানকার সাগরের পানি গাঢ় নীল, যা স্কুবা ডাইভারদের ভীষণ পছন্দ।
সাগরতীরে ঘাট তো রয়েছেই, একটি হেলিপ্যাডও আছে। দিনে একবার করে জাহাজ আসা-যাওয়া করে। চাইলে অবশ্য হেলিকপ্টারেও যাওয়া-আসা করা যায় । তবে যারা যায়, তাদের বলে দেওয়া হয়, ওখানে গিয়ে যেন সব সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনতে থাকে। কারণ এমনিতেই আগ্নেয়গিরিটা জ্যান্ত। তার ওপর আড়াই শ বছর হতে চলল অগ্ন্যুৎপাত হয়নি। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় ওগাশিমায় অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে।