ডিএমপি নিউজ রিপোর্ট: হাতি চলাচলের ছয়টি পথ রেখে দ্রুত নির্মাণ হচ্ছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ। ইতোমধ্যে এক হাজার ৩৯০ একর জমি অধিগ্রহণসহ সব প্রক্রিয়াগত কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে দরপত্রের কাজও শেষ হবে এবং আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে ১৪০ কিলোমিটার সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজ শুরু হবে। এর মধ্যে ১০১ কিলোমিটার মূল লাইন ও ৩৯ কিলোমিটার লুপ লাইন রয়েছে।
প্রথম ধাপে চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ধাপে রামু থেকে মিয়ানমারসংলগ্ন গুনদুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেললাইন হয়ে ট্রান্স এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে এ রেলপথ, যা মিয়ানমার, ভারত, নেপালসহ এশিয়াভুক্ত দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ৩১ মার্চ ও গত ১ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিলংজা ও রামু এলাকা সরেজমিন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি।
কক্সবাজার ঝিলংজা মৌজার চৌধুরীপাড়ায় স্থাপন করা হবে দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল। আর এই টার্মিনাল ঘিরে তৈরি হচ্ছে উৎসবের আমেজ। দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল নির্মাণ হওয়ার খুশিতে আত্মহারা চৌধুরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা। তারা বলেছেন, রেলপথ হলে এলাকার উন্নয়ন হবে ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
ঝিলংজা গ্রামের বাসিন্দা মো:শফিক জানান, আমাদের অনেকের জমি পড়েছে এই টার্মিনালে। তবুও আমরা খুশি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পর্যটন এলাকা কক্সবাজার। দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসবেন। এলাকার উন্নয়ন হবে। অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি হবে।
রেলওয়ের (পূর্ব) সহকারী পরিচালক মহিউদ্দিন বলেন, শিগগিরই আমরা আলোর দেখতে যাচ্ছি দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ওন রামু-ঘুমধুম এ রেল যোগাযোগ প্রকল্প। প্র্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের নান্দনিক সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বদলে যাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডসহ সামগ্রিক চিত্র।
এ রেললাইনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হচ্ছে কক্সবাজার রেলওয়ে টার্মিনাল। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টি মাথায় রেখেই কক্সবাজার প্রান্তের ঝিলংজায় নির্মাণ করা হবে এক দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে টার্মিনাল। নির্মাণ শেষ হলে এ টার্মিনালটি হবে মনোরম স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ এ স্থাপনা পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেবে কয়েক গুণ- যা দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই টার্মিনালকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার। এ টার্মিনালের চারপাশে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হোটেল, বাণিজ্যিক ভবন, বিপণি বিতান, বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণের বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
অগ্রাধিকার ও দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের ১০টি মেগা প্রকল্পের অন্যতম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ।
তিনি আরো জানান, আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্ক ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের (টিএআর) সঙ্গে যুক্ত হতেই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল সাবেক ব্রিটিশ কলোনি মিয়ানমার। মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়।
১৯০৮-০৯ সালে সমীক্ষাও চালায়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পরে ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাও সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেয়া হয়। তৎকালীন সরকারের অনুরোধে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবার সমীক্ষা করে জেআরটিএস। পরে ১৯৯২ সালে এসকাপ কমিশন অধিবেশনে ৩টি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।
শুরুতে মিটারগেজ সিঙ্গেল লাইনে হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে ব্রডগেজসহ ডুয়েল লাইনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে প্রকল্পটি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যটন শহর কক্সবাজার রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এর ফলে পর্যটনশিল্পের যেমন বিকাশ ঘটবে, তেমনি বিস্তৃত হবে সেখানকার ব্যবসায় বাণিজ্যের।
এ রেল লাইন নির্মিত হলে পর্যটকদের কক্সবাজার যাতায়াতে যেমন সুবিধা হবে, সেই সাথে সাধারণ যাত্রীদেরও দুর্ভোগ লাগব হবে অনেকখানি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেল লাইনটি চালু হলেই কক্সবাজারের পর্যটক সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন অনেকে। বর্তমানে পর্যটকদের কক্সবাজার যাতায়াত বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষের ব্যাপার। ঢাকা থেকে বাসযোগে সরাসরি কক্সবাজার যেতে ভাড়া লাগে প্রায় ২,০০০ টাকা এবং সময় লাগে প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। সবচেয়ে বড় কথা, এ দীর্ঘ সময় বাসে ভ্রমণ করা অনেকের জন্যই বেশ কষ্টসাধ্য ও ক্লান্তিকর। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে কক্সবাজার যেতে পারছেন না। আবার ব্যয়বহুল হওয়ায় আকাশপথের যাতায়াতও অনেকের নাগালের বাইরে। ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার যেতে খরচ লাগে প্রায় পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। অনেক পর্যটকেরই এত টাকা ভাড়া দিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার সামর্থ নেই। পর্যটকদের এই ভোগান্তির কথা বিবেচনা করেই জনবান্ধব বর্তমান সরকার রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগের বিষয়টি অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এক্সপ্রেস রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। কক্সবাজার ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের পাশাপাশি সরকারের এ মহৎ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের সাধারণ জনগণ।