তোফা ও তহুরার পর এবার জোড়া মাথার জমজ শিশু রাবেয়া-রোকেয়াকে আলাদা করতে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা। এখন সফল অপারেশনের অপেক্ষায় সবাই। চার ধাপের অপারেশনের প্রথমটি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তাদের চিকিত্সা চলছে। চিকিত্সার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করবেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। ইতোমধ্যে বিদেশি দুই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ ১৮ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই অপারেশন সফল হলে বাংলাদেশে চিকিত্সা বিজ্ঞানে বিরাট দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।
ইরানের দুই বোনের জোড়া মাথা বিশ্বব্যাপী মানুষের আবেগ নাড়িয়ে দিয়েছিল। জানা যায়, বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭ জোড়া মাথার জমজ শিশুর মধ্যে সফল অপারেশনের মাধ্যমে মাত্র ৫ জমজ বেঁচে আছেন। অপারেশনের সময় তাদের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মারা যান। তবে রাবেয়া-রোকেয়ার সফল অপারেশনের ব্যাপারে চিকিত্সকরা আশাবাদী।
বাংলাদেশে জোড়া লাগা তোফা-তোহরা ও মুক্তামনির পর এটি সবচেয়ে বড় ও জটিল অপারেশন। এ ধরনের অপারেশন বাংলাদেশে প্রথম।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকা গ্রামের স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন দম্পতির তিন সন্তান। প্রথম কন্যা সন্তান রাফিয়ার জন্মের ৫ বছর পর গত বছর পাবনা শহরের একটি ক্লিনিকে মাথা জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্ম হয় রাবেয়া-রোকেয়ার।
জন্মগ্রহণের সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই রাত আট টার দিকে অস্ত্রোপচারকক্ষ থেকে খবর আসে, মাথা জোড়া লাগানো যমজ কন্যাশিশুর জন্ম দিয়েছেন তাসলিমা। এটা শুনে নিমেষেই আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। দুশ্চিন্তা ভর করে পুরো পরিবারে। জন্মের সময় কিছুটা অসুস্থ থাকলেও উন্নত চিকিত্সায় সুস্থ হয় শিশু দুটি। তাদের নাম রাখা হয় রাবেয়া ও রোকেয়া। দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় এক বছর। ফুটফুটে শিশু দুটি এখন হাসতে শিখেছে। কিন্তু দিনে দিনে দুশ্চিন্তার পাহাড় জমছে তাদের বাবা-মায়ের মনে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের সমস্যা বাড়ছে। রাবেয়া-রোকেয়ার বাবা-মা দু’জনই অমৃতকুন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিনের কাছে চিকিত্সা করানো হয় রাবেয়া-রোকেয়ার। ডাক্তার জানান রাবেয়া-রোকেয়ার আলাদা করার চিকিত্সা অনেক ব্যয়বহুল।
তারা চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের কাছে গেলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাছে চিকিত্সার জন্য আবেদন করতে বলেন রাবেয়া রোকেয়ার বাবা-মাকে। পরবর্তীতে চিকিৎসার আবেদন ও তাদের ছবি দেখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। সাথে সাথে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
নির্দেশ পাওয়ার পরে ২০ নভেম্বর ঢামেকের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তাদের ভর্তি করা হয়। বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের অধীনে রাবেয়া-রোকেয়ার চিকিত্সা চলছে।
১৮ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের মধ্যে রয়েছেন ডা. সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক আবুল কালাম, প্লাস্টিক সার্জন, দুই জন নিউরো সার্জন, দুই জন প্যাডিয়েটিক সার্জন। হাঙ্গেরির দুই জন নিউরো ও প্লাস্টিক সার্জনকে মেডিক্যাল বোর্ডে সংযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন হাঙ্গেরির মিলিটারি নিউরো সার্জন ডা. এন্ড্রোন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. প্রতাকি।
হাঙ্গেরির আরো একজন চিকিত্সক যিনি বিশ্বখ্যাত হিসেবে পরিচিত এন্ড্রো ভার্সকুলার সার্জন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে এই মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য হয়ে রাবেয়া-রোকেয়ার চিকিত্সা করবেন। তাকে আনার খরচ হাঙ্গেরি সরকার বহন করবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদূত জিয়োজয় শুহা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু দুটির চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর তাদের ঢামেকে আনা হয়। জোড়া বোনের সুস্থতায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চিকিত্সক বোর্ড গঠন করা হয়েছে। যা লাগবে প্রধানমন্ত্রী দিবেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম জানান, রাবেয়া-রোকেয়ার আলাদা করতে চার ধাপের অপারেশন হবে। প্রথম ধাপ ফেব্রুয়ারিতে নিউরো সার্জন, পরে প্লাস্টিক সার্জন, তৃতীয় ধাপে প্লাস্টিক-নিউরো সার্জন এবং চতুর্থ ধাপে প্লাস্টিক সার্জনরা অপারেশন করবেন। প্রথমটার পরের তিনটি অপারেশন শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে হবে। কারণ এই ইনস্টিটিউট হবে অত্যাধুনিক।