ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম নারী আত্মদানকারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মবার্ষিকীর আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে আরও অর্থবহ করে তুলতে হলে নতুন প্রজন্মকে প্রীতিলতার আদর্শ ও সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
এসময় বক্তারা তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম নারী আত্মদানকারী বাংলার স্বাধীনতার অগ্নিশিখা প্রীতিলতার ১০৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে দৈনিক ভোরের কাগজ ও প্রীতিলতা ট্রাস্ট যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে খেলাঘরের শিশুরা শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানে মোমবাতি প্রজ্বলন করে প্রীতিলতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
উল্লেখ্য, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তাঁর ডাকনাম ছিল রাণী, ছদ্মনাম ফুলতার। তিনি এমন একজন বাঙালী ছিলেন, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ ব্যক্তিত্ব।
দৈনিক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, প্রীতিলতা ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যান পংকজ চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু প্রমুখ বক্তব্য দেন। ভোরের কাগজের সাংবাদিক শরীফা বুলবুল অনুষ্ঠানটি সঞ্চলনা করেছেন।
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, প্রীতিলতা আমাদের ইতিহাসের একটি মহৎ অংশ। আমরা যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলি তখনই প্রীতিলতার কথা চলে আসে, প্রীতিলতা আমাদের অস্তিত্বের মাঝে এসে দাঁড়ায়। প্রীতিলতা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ জীবন দান করে উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁকে বাদ দিলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি আমাদেরকে যে উচ্চ আদর্শ দিয়ে গেছেন, কিন্তু বর্তমানে আমরা সেই আদর্শেও জায়গায় আছি কিনা- তা ভাবার সময় এসেছে।
সুলতানা কামাল আরও বলেন, প্রীতিলতাদের আবারও সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাদের সামনে এনে আমাদেরকে নতুন করে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে।
ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু বলেন, প্রীতিলতার মতো বিপ্লবীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। যুগে যুগে প্রীতিলতা নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণা হয়ে আসবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ করতে হলে নতুন প্রজন্মকে প্রীতিলতার আদর্শে ও সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
প্রীতিলতার স্মৃতি রক্ষার জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে প্রীতিলতা ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যান পংকজ চক্রবর্তী বলেন, এর মধ্যে রয়েছে সরকারি অর্থায়নে চট্টগ্রামে প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ। এর কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে এই কমপ্লেক্সটি উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। পংকজ চক্রবর্তী প্রতীলতার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, প্রীতিলতা যে সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, সে সময় নারীর জন্য বিপ্লবী হওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। বিপ্লবীর কখনও মৃত্যু হয়না, তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
নাসিমুন আরা হক মিনু বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমামের জীবন ও বক্তৃতা বিবৃতি নতুন প্রজন্মকে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রীতিলতার সঙগ্রাম ও আত্মাহূতির ইতিহাস বিস্তারিতভাবে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে হবে। এসময় তিনি বলেন, আমরা যখন এই দাবি করছি তখন পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক প্রগতীশীল মনীষীর জীবনী বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি এসময় কোন অন্ধকারের শক্তির কাছে নতজানু না হওয়ার আহ্বান জানান।
বীর বাঙালি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো, যাতে লেখা ছিলো ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে এবং পরবর্তিতে পুলিশ তাদের আটক করে। পুলিশের হাতে আটক এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুকালে প্রীতিলতার শেষ বিবৃতি (চিঠি) তার পকেটে ছিল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন- “নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের বোনেরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করে এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করবেন- এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম।” ২৪ সেপ্টেম্বর হলো প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস।