ডিএমপি নিউজঃ ফেনীর সোনাগাজী থানার মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা তদন্ত শেষে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে বুধবার (২৯ মে) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অভিযুক্ত ১৬ জন হচ্ছে- ১। এসএম সিরাজউদ্দৌলা (৫৭), ২। নুর উদ্দিন (২০), ৩। শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), ৪। মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর (৫০), ৫। সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), ৬। জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), ৭। হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), ৮। আবছার উদ্দিন (৩৩), ৯। কামরুন নাহার মনি (১৯), ১০। উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), ১১। আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ১২। ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ১৩। ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), ১৪। মোহাম্মদ শামীম (২০), ১৫। রুহুল আমিন (৫৫) ও ১৬। মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।
আজ ২৮ মে, ২০১৯ বেলা সাড়ে ১১টায় ধানমন্ডি পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম, পিপিএম।
পিবিআই প্রধান বলেন, ফেনীর সোনাগাজী থানার মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তদন্তে এজাহারনামীয় ৮ জনসহ এজাহার বহির্ভূত আরও ৮ জন অর্থাৎ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয়েছে। গত ২৭ মার্চ ২০১৯ তারিখে নুসরাত জাহান রাফির অভিযোগের ভিত্তিতে তার মা বাদী হয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় একটি শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করা নিয়ে বিরোধ হয়। এই বিরোধের জের ধরে গত ০৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ সকালে নুসরাতকে পরীক্ষা কেন্দ্রে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী মিথ্যা তথ্য দিয়ে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে যায় এবং তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ছাদের সিড়ি দিয়ে নেমে আসলে পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিউটিরত পুলিশ সদস্য ও গার্ড তার আগুন নেভায়। গুরুতর আশংকাজনক অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করানো হয় এবং ১০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে সে মৃত্যুবরন করে।
তিনি আরো বলেন, নুসরাতকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনাটি ঘটার পরপরই পিবিআই মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে সময়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশক্রমে ১০ এপ্রিল পিবিআই মামলাটির তদন্তভার গ্রহন করে। মামলার তদন্তভার গ্রহনের পর আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় দেশের বিভিন্ন জায়গা হতে বিভিন্ন সময়ে হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে পিবিআই।
এছাড়া গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের বক্তব্য ও দেখানো মতে, মামলার বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত আলামাতসমূহের মধ্যে অন্যতম হল- কেরোসিন তেল বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন, একটি কাচের গ্লাস যা রাফির গায়ে অগ্নিদগ্ধ করার সময় তেল ঢালতে ব্যবহৃত হয়, দেয়াশলাইয়ের কাঠি, নুসরাত জাহান রাফির হাতে লেখা সম্বলিত খাতা যাতে অধ্যক্ষ কর্তৃক তাকে উত্ত্যক্ত করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে, ০৩টি কালো রঙের বোরখা ও আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম এর স্বীকারোক্তি মোতাবেক তার ব্যবহৃত একটি মোবাইল সেট যাতে তার সাথে অপর আসামী রুহুল আমিন এর সাথে ঘটনার বিষয়ে কথপোকথনের রেকর্ড রয়েছে।
সার্বিক তদন্তে মামলার ঘটনার বিষয়ে পিবিআই প্রধান জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফির করা অভিযোগ ও মামলায় সিরাজউদ্দৌলা গ্রেফতার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। গত ০১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা আসামী সিরাজউদ্দৌলার সাথে জেলখানায় দেখা করে। সেখানে সিরাজউদ্দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশনা দেয়। হুমকী ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নিলে আসামীরা নুসরাতের উপর ক্ষুব্ধ হয়। এর আগে আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। ফলশ্রুতিতে শাহাদাত হোসেন শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সাথে আলোচনা করে নুসরাত জাহান রাফিকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যে কোন কিছু করার পরিকল্পনা করে। কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা দেয়।
উক্ত টাকা দিয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুইটি বোরখা ও ৪ জোড়া হাতমোজা কেনায়। পরবর্তীতে সময়ে ০৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার সাথে দেখা করে। সেখানে সিরাজউদ্দৌলা তাদের নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ প্রদান করে এবং হত্যাকান্ডের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
পরিকল্পনা মোতাবেক ০৪ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে বিকাল আনুমানিক ১৫:০০ ঘটিকায় মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুউদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহার সহ আরো কয়েকজন মিটিং করে এবং নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ০৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ সকাল ০৭:০০/০৭:৩০ ঘটিকার দিকে শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ০৮:০০ হতে ০৯:২০ ঘটিকার মধ্যে তারা যার যার অবস্থানে চলে যায়। শাহাদাত হোসেন শামীম পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। কামরুন্নাহার মনির কেনা দুইটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি মোট ০৩ টি বোরখা ও ০৪ জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের ০৯:৩০ ঘটিকার দিকে বোরখা ও হাত মোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে। নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বে অবস্থান করা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। নুসরাত ২য় তলায় পৌছালে উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়, নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সাথে ছাদে উঠলে আসামী কামরুননাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের, ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকী প্রদান করে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামীরা ক্ষিপ্ত হয়। শাহাদাত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে নিয়ে আসে। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দুভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পিছনে বেধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে আসামী জোবায়ের নুসরাতের পা পেচিয়ে ফেলে। আসামী জাবেদ পায়ে গিট দেয়। সকলে মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। কামরুন নাহার মনি নুসরাতের বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরে এবং উম্মে সুলতানা পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে, এরপর উম্মে সুলতানা পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ঐ সময় পূর্বের শিখানো মতে কামরুন নাহার মনি উম্মে সুলতানা পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। আসামী জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের ৩য় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলে। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরখা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে। শাহাদাত হোসেন শামীম নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় ও মাদ্রাসার পুকুরে বোরখা ফেলে দেয়। আসামী জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরখা ও হাত মোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। আসামী নুরু উদ্দীন সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকীর দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া আসামী মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত থাকে। মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারারত থাকে। হত্যাকান্ড সংঘটিত করার পর আসামীরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারনা চালায়।
নুসরাত জাহান রাফি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নিভায়। ঐ সময় আসামী নুর উদ্দীনও নুসরাতের গায়ে পানি দেয় এবং আসামী হাফেজ আব্দুল কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরবর্তীতে নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। নুসরাত জাহান রাফি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দী প্রদান করে। উক্ত জবানবন্দীতে তাকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনাটি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে।