বছর দু’য়েক আগে হদিশ মিলেছিল এমন একটি পতঙ্গের শূককীটের যা কুরে কুরে খায় প্লাস্টিককে। গত বছর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এমন একটি ব্যাকটেরিয়ার, যা ক্ষয় ধরিয়ে দিতে পারে প্লাস্টিকে।

এ বার দেখা গেল, প্লাস্টিককে ‘খেয়ে’ ফেলতে পারে বিশেষ এক ধরনের ছত্রাকও! যারা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে প্লাস্টিক অণুগুলিকে জোরালো বলে বেঁধে রাখার বন্ড বা ‘হাত’গুলিকে। তার ফলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্লাস্টিকের অণুগুলি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাটিতে মিশে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে সেই সব প্লাস্টিক, যারা ১০ লক্ষ বছরেও মাটিতে মিশে যায় না।

প্লাস্টিককে বধ করার এমন একটি ছত্রাকের সন্ধান মিলেছে বলে দাবি করেছেন চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী, গবেষকরা। পাকিস্তানের গবেষকদের সঙ্গে জোর তল্লাশি চালিয়ে ইসলামাবাদের আবর্জনার স্তূপ থেকে সেই প্লাস্টিক বিনাশী ছত্রাকের হদিশ পেয়েছেন তাঁরা। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘এনভায়রনমেন্টাল পলিউশান’-এর জুন সংখ্যায়। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘বায়োডিগ্রেডেশন অফ পলিয়েস্টার পলিইউরিথেন বাই অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনসিস’।

গবেষকরা যে ছত্রাকটির হদিশ পেয়েছেন, তার নাম- অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনসিস। ছত্রাকটি জন্মায় মাটিতে। তবে গবেষণাগারে ওই ছত্রাকদের প্লাস্টিকের ওপরেও জন্মাতে দেখেছেন গবেষকরা। এই ছত্রাকটি থেকে বেরিয়ে আসে এক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক (যা আদতে প্রোটিন)। যা প্লাস্টিকের অণুগুলিকে বেঁধে রাখার বন্ডগুলিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। আর সেটা করে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। যাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটা প্লাস্টিক পুরোপুরি ক্ষয়ে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতে পারে।

একই ভাবে মরা গাছপালা বা প্রাণীদের জৈব বর্জ্যের (অরগ্যানিক মেটিরিয়্যালস) ওপর বসে ছত্রাক তাদের নিকেশ করে দেয়। এটা আগেই জানা ছিল। কিন্তু অ্যাসপারগিলাস টুবিনজেনসিসের মতো বিশেষ এক ধরনের ছত্রাক যে বিশেষ এক ধরনের প্লাস্টিক পলিয়েস্টার পলিইউরেথেনের অণুগুলিকেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে, এই প্রথম বিশেষ ধরনের স্পেকট্রোস্কোপিতে তা দেখা গিয়েছে বলে গবেষকদের দাবি।

২০১৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রেগ ক্রিডলের নেতৃত্বে এক গবেষকদল দেখিয়েছিলেন, কোনও কোনও পতঙ্গের শূককীট (মিলওয়র্ম) প্লাস্টিক খেয়ে ফেলতে পারে! আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্র জানিয়েছিল, ১০০টি শূককীটকে বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক স্টাইরোফোম খাওয়ানো হয়েছিল ৩৪ থেকে ৩৯ মিলিগ্রাম করে। খাওয়ানো হয়েছিল আরও এক ধরনের প্লাস্টিক পলিস্টাইরিনও। ওই শূককীটগুলিকে বাঁচার জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড নিতে হয়। দেখা গিয়েছিল যে পরিমাণ প্লাস্টিক খাওয়ানো হয়েছিল, বাঁচার রসদ জোগাড় করতে তার অর্ধেকটা ভেঙেই কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে নিয়েছে শূককীটগুলি। বাকি প্লাস্টিকটুকুকে তারা মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো পদার্থে পরিণত করে ফেলেছে। আর সেই প্লাস্টিক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছিল শূককীটগুলি।

গত বছর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র (‘আ ব্যাকটেরিয়াম দ্যাট ডিগ্রেডস অ্যান্ড অ্যাসিমিলেটস পলি (ইথিলিন টেরেপথ্যালেট)’) দেখিয়েছিল, ইডিওনেল্লা সাকাইএনসিস ২০১-এফ৬ নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া তার বাঁচার রসদ কার্বন ডাই-অক্সাইড জোগাড় করতে পলিইথিলিন টেরেপথ্যালেট নামে একটি বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক যৌগকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।

হালের গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্লাস্টিকখেকো ছত্রাকটির বিভিন্ন মাধ্যমে আচার-আচরণে ভিন্নতা থাকে। তারা কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্লাস্টিক অণুকে ভাঙতে পারবে, তা নির্ভর করে কোন মাধ্যমে আর কোন তাপমাত্রায় তাদের রাখা হচ্ছে তার ওপর। ২ শতাংশ গ্লুকোজ মিশিয়ে গবেষকরা ওই ছত্রাকটিকে তিনটি মাধ্যমে রেখে কাজ করেছিলেন। একটি কালচার করা মাধ্যম এসডিএ আগর প্লেট, দ্বিতীয়টি তরল মাধ্যম। আর শেষেরটি মাটি- মাটিতে ছত্রাকটিকে পুঁতে রেখে। তাতে দেখা গিয়েছে, ছত্রাকটির প্লাস্টিক ধ্বংসের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি কালচার করা মাধ্যমে। তার পর তরলে। আর সেই ক্ষমতা সবচেয়ে কম মাটিতে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৪ সালে বিশ্বে প্লাস্টিক উঞপাদনের পরিমাণ ৩১ কোটি ১০ লক্ষ টন। যা ২০৫০ সালে হবে ১ হাজার কোটি ১২ লক্ষ ৪০ হাজার টন। শুধু তাই নয়। সমুদ্রের তলায় জমা প্লাস্টিকের চেয়ে এখন মাছের সংখ্যা দেড় গুণ বেশি থাকলেও, ২০৫০ সালে সেই অনুপাত ১.১-এর নীচে গিয়ে পৌঁছবে। ফলে সমুদ্রে মাছ আর জমা প্লাস্টিকের পরিমাণে তেমন ফারাক থাকবে না।

এই পরিস্থিতিতে সুস্থ পরিবেশ ও নিখুত বাস্তুতন্ত্রের জন্য দ্রুত প্লাস্টিক নিকেশ অত্যন্ত জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্লাস্টিকখেকো ছত্রাকরা আগামী দিনে কী ভূমিকা নিতে পারে, সেটাই এখন দেখার।-আনন্দবাজার