ফুটবল বিশ্বকাপ চার বছর পর পর ফুটবল প্রেমীদের কাছে আসে। তাই এই নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। পতাকা বানাও, সাপোর্ট কর, খেলা দেখ আরও কত কি। সারা বিশ্বেই চলে এই উম্মাদনা। কিন্তু আমরা যারা ফুটবলকে ভালবাসি, মনে ধারন করি তারা অনেকেই জানি না এই খেলার আদি উৎপত্তি কোথায় বা প্রাচীন যুগে ফুটবল কারা খেলত বা আদৌ কেউ খেলত কিনা বা এই “ফুটবল” প্রাচীন থেকেই এমন ছিল কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ধারনা করা যায় ফুটবল খেলা প্রথম শুরু করেছিল গ্রিক এবং রোমান সম্প্রদায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকে। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানরা বল দিয়ে বিভিন্ন রকমের খেলা খেলত, তার মধ্যে কিছু কিছু খেলা পা ব্যবহার করে খেলত। রোমান খেলা Harpastum এসেছে গ্রিক খেলা Episkyros থেকে যা গ্রিক নাট্যকার Antiphanes (388–311 BC) এবং পরে ক্রিস্টিয়ান দার্শনিক Clement of Alexandria (c.150-c.215 AD) তাদের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই খেলাটা রাগবি ফুটবল খেলার মত ছিল। রোমান রাজনীতিবিদ Cicero (106–43 BC) বর্ণনা করেছেন ঐ খেলার সময় একজন মানুষ নাপিতের দোকানে সেভ হওয়ার সময় বলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন। ঐ বল গুলো বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকত অনেকটা বেলুনের মত।
ফিফার তথ্য অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক খেলা cuju ই হল ফুটবল খেলার সর্বপ্রথম রুপ যার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। যদিও ফিফা প্রাচীন গ্রিক খেলা Episkyros কে ফুটবল খেলার সর্বপ্রথম রুপ হিসেবে আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিলিটারিরা অনুশীলন হিসেবে এটা খেলত। ঐতিহাসিক চাইনিজ মিলিটারি গ্রন্থ Zhan Guo Ce যা প্রণীত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ১ম শতাব্দীর মধ্যে যা তে ফুটবল কথাটি খুঁজে পাওয়া যায়। এতে মিলিটারিদের একটা অনুশীলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যা cuju নামে পরিচিত(cuju মানে kick ball) আর এটা খেলার জন্য একটা চামড়ার বল প্রয়োজন ছিল যাকে পা দিয়ে লাথি মারা হত এবং সিল্কের কাপর দিয়ে ছোট হোল তৈরি করা থাকত মাটি থেকে ৯ মিটার উপরে বাশের সাথে। চীনের হ্যান সাম্রাজ্যের সময় (206 BC–220 AD), cuju খেলার নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে এই খেলার বিভিন্ন রুপ জাপানে এবং কোরিয়াতে বিস্তার লাভ করে, জাপানে এই খেলা kemari এবং কোরিয়াতে chuk-guk নামে পরিচিত। পরে আরেক ধরনের গোলপোস্ট বানানো হয় যা মাঠের মাঝখানে বসানো থাকত। অশোকা সাম্রাজ্যের সময় জাপানে kemari খেলা বিকাশ লাভ করে।kemari খেলার নিয়ম ছিল কয়েক জন মানুষ একটা বৃত্তাকার মাঠের ভিতর বল লাথি দিয়ে খেলবে তবে তারা চেষ্টা করত বল যেন মাটিতে ড্রপ না পড়ে বা যেন শূনে ভেসে থাকে।
তবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে বল খেলা বিভিন্ন দেশে মানুষেরা খেলত। যেমন ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ অনুসন্ধানকারী John Davis গ্রিনল্যান্ডের Inuit দের সাথে ফুটবল খেলেছিল। ১৬১০ সালে আমেরিকানদের খেলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন William Strachey নামের একজন ঔপনিবেশিক। তবে অস্ট্রেলিয়ায় লাথি মেরে বল খেলা শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান উপজাতিরা যা বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায়। নিউজিল্যান্ডে Māori রা প্রথম বল খেলা শুরু করে যার নাম ছিল Ki-o-rahi এবং এই খেলার নিয়ম ছিল একটা বৃত্তাকার মাঠকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একটা করে দল থাকত এবং প্রত্যেক দলে ৭ জন করে খেলোয়াড় থাকত এবং মাঠের মাঝখানে একটা বৃত্তাকার সীমানা থাকত। দুই ভাবে এই খেলার পয়েন্ট নির্ধারিত হত তা হল একদন আরেক দলের সীমানা পার করে দিতে পারলে এবং মাঝের বৃত্তটা স্পর্শ করতে পারলে বল দিয়ে। ইউরোপে তথা ইংল্যান্ডে বল খেলা শুরু হয়েছিল ৯ম শতাব্দীতে যা Historia Brittonum বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম দিকে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল “mob football” এবং যা খেলা হত মূলত প্রতিবেশী শহরগুলোর মধ্যে এবং ইহা খেলা হত বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনে। এই খেলায় দুই দলে অগণিত খেলোয়াড় থাকত এবং এরা একটা বলকে গায়ের জোরে ধাক্কা ধাক্কি করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে পারলে পয়েন্ট হত।
আয়ারল্যান্ডে ১৩০৮ সালে ফুটবল খেলা হয়েছিল যা John McCrocan নামের একজন দর্শক খেলাটা দেখেছিল যা তার বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির Florence শহরে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল “calcio storico” এবং পরবর্তীতে এই “calcio storico” ই হল আধুনিক ফুটবলের প্রাথমিক রুপ।
এই খেলায় সর্বচ্চ ২৭ জন খেলোয়াড় থাকত এবং প্রত্যেক দলে বিভিন্ন সংখ্যার খেলোয়াড় থাকত যেমন কোন দলে ১৫ জন আবার কোন দলে ২০ জন এবং গোলরক্ষক থাকত ৫ জন। কিন্তু এই নিয়ম বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে তাই পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে আইন করা হয় যে প্রত্যেক দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকতে হবে এবং এর মধ্য থেকে একজন গোলরক্ষক থাকবে একটি দলে। তাই ১৮৭০ সাল থেকেই আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়। অনেক গবেষণা করে দেখা যায় যে ১০+১০=২০ জন খেলোয়াড়ই যথেষ্ট পুরো মাঠটা কভার করতে। তাই এই ১১+১১=২২ জনের নিয়ম করা হয়।
১৯২৮ সালে সর্বপ্রথম আর্সেনালের পরিচালক পর্ষদ সহজে চেনার জন্য খেলোয়াড়দের জার্সিতে নাম্বা্র বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। তখন স্বাগতিক দলের জার্সি নাম্বার থাকত ১-১১ পর্যন্ত এবং সফরকারী দলের নাম্বার থাকত ১২-২২ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৪০ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে একই নাম্বার বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রাও নিতে পারবে কিন্তু নাম্বার ঐ ১-২২ পর্যন্ত থাকতে হবে। ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম জার্সিতে খেলোয়াড়ের নাম লেখা হয় এবং যেকোন নাম্বার খেলোয়াড় নিতে পারবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর থেকেই মুলত ফুটবল বাধা মুক্ত হয়। তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট।