১৮৭২ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যেকার ম্যাচ দিয়ে বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা হয়েছিল । এরপর প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয় ১৮৮৪ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশিপ। সেই সময়ে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের বাইরে ফুটবল খেলার তেমন চল ছিল না ৷ তারপর উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ ১৯০০, ১৯০৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রদর্শনী খেলা হিসেবে ফুটবলকে রাখা হলেও এর জন্য কোনও পুরস্কার বরাদ্দ ছিল না। ১৯০৮ সালের অলিম্পিকে ফুটবল প্রথম আনুষ্ঠানিক খেলার মর্যাদা পায়। এফএ-র পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রতিযোগিতা ছিল অপেশাদার খেলোয়াড়দের জন্য এবং এটিকে প্রতিযোগিতার চেয়ে প্রদর্শনী হিসেবেই দেখা হত। ১৯০৮ ও ১৯১২ দু’টি অলিম্পিকেই গ্রেট ব্রিটেন (যাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল ইংল্যান্ড জাতীয় অপেশাদার ফুটবল দল) জয়লাভ করে।
এদিকে ১৯০৪ সালে ফিফা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঠিক পরেই, ১৯০৬ সালে ফিফা সুইজারল্যান্ডে অলিম্পিকের আদল থেকে ভিন্ন একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক ফুটবলের বয়স তখনও অনেক কম এবং হয়ত একারণেই ফিফার ইতিহাসে এই প্রতিযোগিতাকে ব্যর্থ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
অলিম্পিকে অপেশাদার দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলার পাশাপাশি স্যার থমাস লিপটন ১৯০৯ সালে তুরিনে স্যার থমাস লিপটন ট্রফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এটি ছিল বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ক্লাবের (জাতীয় দল নয়) মধ্যে একটি চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা। এসব দলের প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, এজন্য এই প্রতিযোগিতাকে অনেকে এক অর্থে প্রথম বিশ্বকাপ বলেন। এতে ইতালি, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড-সহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা পেশাদার দল অংশ নেয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের দ্য ফুটবল এসোসিয়েশন এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে জড়িত থাকতে ও পেশাদার দল পাঠাতে রাজি হয়নি। তখন ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য লিপটন পশ্চিম অকল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানায়, এটি ছিল ডারহ্যাম কাউন্টির একটি অপেশাদার দল। পশ্চিম অকল্যান্ড এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯১১ সালেও এই প্রতিযোগিতায় শিরোপা ধরে রাখতে সমর্থ হয়।
১৯১৪ সালে, ফিফা অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতাকে “অপেশাদার বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় এবং এই প্রতিযোগিতা পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এর ফলে ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় মিশর ও তেরটি ইউরোপীয়ান দল। বেলজিয়াম চ্যাম্পিয়ন হয়ে সোনা জেতে। পরের দুটি অলিম্পিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালে উরুগুয়ে সোনা জিতে ছিল।
১৯২৮ সালের অলিম্পিকে ফুটবল প্রতিযোগিতার সাফল্য দেখে তৎকালীন ফিফা সভাপতি জুলে রিমে অলিম্পিকের বাইরে আলাদাভাবে নিজস্ব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে সেই সময়ে পরপর দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে অন্যদিকে আবার ওই দেশে স্বাধীনতার শতবর্ষ উৎযাপনের আয়োজন চলছে৷ সব দেখে বুঝে ফিফা তখন ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে উরুগুয়েকেই বেছে নেয় ৷
সেই মতো বিভিন্ন দেশের জাতীয় ফুটবল সংস্থাকে এতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু উরুগুয়েতে বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলির পক্ষে সেখানে গিয়ে খেলা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলি সেখানে দল পাঠাতে রাজি ছিল না। জুলে রিমে শেষ পর্যন্ত বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া, ও যুগোস্লাভিয়া থেকে দল আনাতে সক্ষম হন। মোট ১৩টি দেশ প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সাতটি, ইউরোপ থেকে চারটি ও উত্তর আমেরিকা থেকে দু’টি দেশ ছিল৷ ফাইনালে উরুগুয়ে আর্জেন্তিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্বের অধিকার হয়৷
এদিকে আলাদা ভাবে ফুটবল বিশ্বকাপের তোড়জোড় দেখে ফিফা এবং আইওসি’র মধ্যে পেশাদার ও অপেশাদার খেলার মর্যাদা নিয়ে মতবিরোধও দেখা দেয়। ফলে ফুটবল অলিম্পিক থেকে বাদ পড়তে দেখা যায় ৷ ১৯৩২ সালের লস এঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ফুটবলকে না রাখার পরিকল্পনা করা হয়৷ যুক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে তখন ফুটবল জনপ্রিয় ছিল না। সেখানে ফুটবলের পরিবর্তে রাগবি (যা অনেকের কাছে আমেরিকান ফুটবল বলে পরিচিত) জনপ্রিয় ছিল। তবে এটাও ঠিক ১৯৩২ সালে অলিম্পিকে ফুটবল প্রতিযোগিতা না হলেও ঠিক তার পরের অলিম্পিক ১৯৩৬ সালে ফের ফুটবল ফিরে আসে৷ তারপর থেকে অলিম্পিকে ফুটবল থাকলেও পেশাদারদের অংশ গ্রহণ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ থাকায় ক্রমশ ফুটবলে বিশ্বসেরার মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়তে থাকে৷ পাশাপাশি বিশ্বকাপের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় ম্লান হয়ে যায় অলিম্পিক ফুটবল ৷