মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সম্ভাবনাকে বেশ বড় করে দেখা হয়েছিল। এরই মধ্যে বেশ লম্বা সময় অতিবাহিত হলেও এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ এখনও অনুপস্থিত। ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সমুদ্র থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে অর্থ সহায়তা চেয়ে আসছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে এ বিষয়ে প্রস্তাবিত একটি প্রকল্পে ২০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে এ প্রকল্পের সহায়তা প্রস্তাব সংস্থার বোর্ড সভায় উঠবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমুদ্রে মাছ আহরণ বাড়বে। ফলে শক্তিশালী হবে ব্লু ইকোনমি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। আর মাছ চাষে অবস্থান পঞ্চম স্থানে। অভ্যন্তরীণ আহরণ ও চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে এ দেশ সামনের সারিতে থাকলেও পিছিয়ে আছে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র সাড়ে ১৮ শতাংশ আসছে উপকূল ও সমুদ্র থেকে। শৃঙ্খলার অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো আর দক্ষ জনশক্তির অভাবে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উপকূল ও সমুদ্র থেকে পর্যাপ্ত মাছ আসছে না। এ অবস্থায় সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ বাড়াতে প্রকল্পটি নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একনেকের অনুমোদন পেলে ৫ বছরে টেকসই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদফতর।
মূলত উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিবেশের ভারসাম্যও প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। মৎস্য চাষ ও মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির জীবনমান উন্নয়নে প্রকল্পটিতে গুরুত্ব দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, সুশাসন ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটির আওতায় ৭ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে। এ অর্থ ব্যয় করে সরকার ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হবে। ফলে বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারের সক্ষমতা বাড়বে। এ অর্থ ব্যয় করে সরকারি ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করা হবে। ২০০৮ সালে প্রণীত মৎস্য নীতির সংস্কার করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। উপকূলীয় মৎস্য ব্যবস্থাপনায় মৎস্য অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। তাছাড়া মৎস্য খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, সততা প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করায়ও গুরুত্ব দেয়া হবে।
প্রকল্পটির আওতায় মৎস্য আহরণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও কাক্সিক্ষত পুষ্টি নিশ্চিত করতে ৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় মাছ আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির দক্ষতা বাড়ানো হবে। তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন ও উপকূলীয় জলবায়ু রক্ষায়ও অর্থ বরাদ্দ থাকবে। শৃঙ্খলা রক্ষায় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জনশক্তিকে পরিচয়পত্র দেয়া হবে প্রকল্পের আওতায়। মাছ আহরণে নিয়ন্ত্রণ আনতে এসব পরিচয়পত্রের আলোকে দেয়া হবে খাদ্য সহায়তা।
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রকল্পটির আওতায় আরও ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করা হবে। আহরণ করা মাছের মান ধরে রাখার পাশাপাশি সহায়ক শিল্পের মাধ্যমে নতুন করে মূল্য সংযোজনের উদ্যোগ নেয়া হবে এর আওতায়। তাছাড়া ব্লু ইকোনমির উন্নতির মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছ রফতানিতেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে।
বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার মূল্যমানের মাছ আহরণ করা হয়ে থাকে। এর প্রায় সাড়ে ৫২ শতাংশ আসে মাছ চাষের মাধ্যমে। নদী-নালা ও অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আসে ২৯ শতাংশ। অবশিষ্ট সাড়ে ১৮ শতাংশ মাছ আহরণ করা হয় উপকূল ও সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়। আর সামুদ্রিক উৎস থেকে আহরণ করা হয় ৬ লাখ মেট্রিক টন মাছ। এর বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৫১ কোটি ডলার। সামুদ্রিক মাছের ৪০ শতাংশ অবদান ইলিশের। আহরণ করা মাছের প্রায় ৮ শতাংশ চিংড়ি।
বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় মৎস্য খাত বড় ভূমিকা রাখছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশনায় দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাণীজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসছে মাছ থেকে। খাদ্য হিসেবে মাছের ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। মাছ খাত সংশ্লিষ্ট পেশায় দেশটির প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিয়োজিত আছে। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছ আহরণে নিয়োজিত আছে ৫০ লাখ মানুষ। এর পরও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অনুপস্থিতি, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সামর্থ্যরে অভাবে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বাড়ছে না বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক ।