বিশেষ প্রতিবেদনঃ গত মে মাসের ২১ তারিখ। ফকিরাপুলের আল-শাহিন হোটেলের ৪র্থ তলার ১৬ নম্বর রুমের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল এক শিশুর গগণবিদারী কান্নার শব্দ। রুমের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। সন্দেহ হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ ফোন করে মতিঝিল থানায়। মতিঝিল থানা পুলিশসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন হোটেল রুমের দরজা। কান্নার শব্দ তখন আর নেই। ভেতরে দেখা গেল ভয়ংকর দৃশ্য। বিছানার লোহার ফ্রেম আর দেয়ালের মাঝখানের অংশে শুধুমাত্র মাথার উপর ভর করে ঝুলে আছে একটি শিশু। শিশুটির কান আর গালের পাশে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। বিকট গন্ধ ছড়াচ্ছে বিছানাতে পড়ে থাকা এক নারীর লাশ। লাশের গলায় অনেকগুলো গিঁট দেয়া ওড়না প্যাঁচানো। প্রথমেই শিশুটিকে উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল শিশুটি মৃত। পরক্ষণেই পুলিশের এ্ক কর্মকর্তার চোখে ধরা পড়ে শিশুটির হাতের আঙ্গুলের সূক্ষ নড়াচড়া। বোঝা গেল তখনো শিশুটি জীবিত। মুহূর্তেই শিশুটিকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে ছুট লাগায় মতিঝিল থানার একটি টহল টিম। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে শুশ্রুষা চলতে থাকে শিশুটির।
এদিকে আল শাহিন হোটেলের সেই রুমে ঐ নারীর লাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পুলিশের কর্মকর্তারা। হোটেল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় এক দম্পতি বাচ্চাসহ গত ২১মে ভোরে তাদের হোটেলে রুম ভাড়া নিতে আসে। বাচ্চাটি কান্নাকাটি করছিল বিধায় হোটেল ডেস্কে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন না করেই রুমে চলে যায় তারা। পরবর্তী সময়ে রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য হোটেল বয় রুমে গেলে সেটির দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখে ফিরে আসে। আরো পরে হোটেলের ঐ রুমের পাশের রুমের বাসিন্দা হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানায় ১৬ নম্বর রুমটি থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে অনেকক্ষণ ধরে। সন্দেহ হওয়ায় তারা পুলিশকে বিষয়টি জানালে পুলিশ হাজির হয়। তখন বোঝা গেল সঙ্গে আসা ঐ পুরুষটি পলাতক। প্রশ্ন উদয় হল সে কোথায়? সে-ই কি হত্যাকারী? যদি হয়ে তবে কেন হত্যা করল? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে থাকে পুলিশ।
হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাদের পরিচয় জানার কোন উপায় রইল না। রুম সার্চ করে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ পেলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ব্যাগের ভেতর খুঁজে পাওয়া গেল তিনটি জিনিস। লক্ষীপুরের রামগতির একটি স্বর্ণকারের দোকানের ভিজিটিং কার্ড, চট্টগ্রাম-সোনাপুরের একটি বাসের টিকিট এবং পুরনো ছেঁড়া একটি কাগজে লেখা একটি ফোন নম্বর। বলে রাখা প্রয়োজন হোটেলটি বা আশেপাশের কোন স্পটে কোন সিসিটিভি না থাকায় ঐ নারীর স্বামীর কোন ছবিও পাওয়া সম্ভব হয়নি। আবার ঐ নারীর আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেজ মিলিয়েও পাওয়া যায়নি কোন তথ্য।
অতএব পুলিশের কাছে সূত্র বলতে ওই তিনটি জিনিস ছাড়া আর কিছুই নেই। তা-ই দিয়েই এই হত্যা রহস্যের তদন্তে নামে মতিঝিল থানা। প্রথমে ঐ স্বর্ণকারের দোকানের খোঁজ শুরু করে পুলিশ । সরেজমিনে তদন্ত করতে তদন্ত কর্মকর্তা চলে যান লক্ষীপুরে। সেই দোকানে গিয়ে মৃত ঐ নারীর লাশের ছবি দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয় তাকে কেউ চেনে কিনা। নিরাশ করেন স্বর্নকারের দোকানের কর্মচারীরা। শেষমেষ সেই স্বর্ণকারের কাছে ছবির একটি কপি ও তদন্ত কর্মকর্তার একটি ফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ করা হয় যে যদি কেউ মহিলাকে চেনে তবে সাথে সাথে যেন এই নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। মনে হচ্ছিল আর বুঝি কিনারা হল না এই হত্যা রহস্যের। কিন্তু হাল না ছেড়ে ওই নারীর পরিচয় উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে পুলিশ। তখন ঘূর্ণিঝড় ‘মরা’ আঘাত হানতে আসছে উপকূলে। আবহাওয়া খুব খারাপ। এর মধ্যেই লক্ষীপুর ও বাসের টিকিটের সূত্র মোতাবেক নোয়াখালীর সোনাপুর এলাকায় ওই নারীর ছবি পাঠিয়ে থানার সহায়তায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে চলতে থাকে খোঁজ। বিভিন্ন থানার রেকর্ড ঘেঁটেও ঐ নারীর নামে কোন মামলা বা অভিযোগ অথবা কোন নিখোঁজ সংবাদের তথ্য মিলল না। ছেঁড়া কাগজে পাওয়া ফোননম্বরটিতে যোগাযোগ করেও কোন ফল হল না। তবে কি অধরাই থেকে যাবে খুনী?
এরপর খবর আসল হঠাৎ করেই। জুনের ৮ তারিখ সেই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে একটা ফোন আসে সেই নারীর মামা পরিচয়ে। কোথায় পেলেন ফোন নম্বর ? ভদ্রলোকের ভাষ্যমতে ঐ যে স্বর্ণকারের দোকান সেখানে মৃত নারীর একজন প্রতিবেশী মহিলা স্বর্ণ কিনতে গেলে দোকানদার পুলিশের রেখে আসা ছবিটি দেখানো মাত্রই ঐ মহিলা চিনতে পারে। জানা যায় মৃত নারীর নাম রিনা। সেই মহিলা রিনার মামার সাথে যোগাযোগ করে তদন্ত কর্মকর্তার ফোন নাম্বার দেয়। সেই নম্বরে এরপর যোগাযোগ করেন মামা। মামার কাছ থেকে মৃত নারীর বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। তার পুরো নাম রিনা আক্তার সাবিনা(২০), স্বামীর নাম টিপু সুলতান(২৩)। টিপু সুলতান চট্টগ্রামে একটি দোকানে কাজ করত আর রিনা কাজ করত একটি গার্মেন্টসে। টিপুর সাথে এক বছরের প্রেম ছিল রিনার। দেড় বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। কিছুদিন আগে রিনার বাবার বাড়ি নোয়াখালিতে থাকা অবস্থায় তাদের একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান হয় । গত ১৭ মে সন্তানসহ রিনাকে নিয়ে বাসে করে চট্টগ্রামে গিয়েছিল টিপু। সেই বাসের টিকিটই পাওয়া গিয়েছিল রিনার ভ্যানিটি ব্যাগে।
ভিকটিমের মামা ও ভাইয়ের কাছ টিপু সুলতানের একটা ফোন নাম্বার ও ছবি সংগ্রহ করে মতিঝিল থানা পুলিশ। সেই ফোন নম্বরের সূত্র ধরে টিপুর খোঁজ পাওয়া যায় চট্টগ্রামে। এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করে সিআইডি, ঢাকা। আর টিপুকে গ্রেফতারে সহায়তা করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা। পুলিশ টিপুকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সে স্বীকার করে রিনা তার স্ত্রী, তাকে সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার কারন জানতে চাইলে সে জানায়, দেড় বছর আগে সে রিনাকে প্রেম করে বিয়ে করে কিন্তু এই বিষয়টি তার পরিবার জানত না। পরিচিত কেউ একজন বাচ্চা কোলে টিপুর একটি ছবি তার পরিবারের কাছে পাঠালে তার পরিবার বিয়ের বিষয়টি জানতে পারে। জানার পর পরিবার বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য টিপুকে চাপ দেয়। চাপ দেয়ার ফলে কোন উপায়ন্তর না দেখে সে তার স্ত্রী রিনাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে সে রীনাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে আসে। ঢাকায় সারাদিন সে রিনাকে না খাইয়ে রাখে যাতে সে দূর্বল হয়ে পড়ে। দূর্বল হয়ে পড়লে সে হোটেলের রুমে তাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। শিশুটিকে শুইয়ে রেখে যায় লাশের পাশে। এভাবেই মতিঝিল থানা পুলিশের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উদঘাটন হয় এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য।
মতিঝিল ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো আরিফুল ইসলাম ডিএমপি নিউজকে জানান হত্যাকান্ডের ব্যাপারে গত ১১ জুন টিপু সুলতান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। আর সেই শিশুটি এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তার কান ও মুখের ক্ষতগুলোর চিকিৎসা চলছে। অচিরেই সে সুস্থ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিএমপি নিউজ/এসকেসি