বাবাকে হত্যার পর পাঁচ বছরের শিশু মরিয়ম খাতুনকে দেয়ালে ছুড়ে মেরেছিল মিয়ানমারের সেনারা। এরপর ছোট্ট ওই শিশুকে বুট জুতা দিয়ে লাথি মারতে থাকে সেনাদের আরেকটি দল। একপর্যায়ে সেনারা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর মরিয়মকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে চলে আসে। ব্যথায় পুরো পথ কাতরাচ্ছিল মরিয়ম। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা পেলেও মিয়ানমারের সেনাদের হামলায় তার যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনোভাবেই আর সারানোর নয়। হামলায় তার ‘পেলভিক ফ্র্যাকচার’ ও গুরুতর ‘নিউরোলজিক্যাল ইনজুরি’ হয়েছে। মরিয়ম এখন হাঁটতে পারে না। তার পা দুটি সামান্যই নাড়াতে পারে।
গণনৃশংসতা ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কাজ করা নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংস্থা ‘ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর) কক্সবাজারে এসে মরিয়মের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। পিএইচআরের পর্যবেক্ষণ হলো—মরিয়মের পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
গত বুধবার পিএইচআরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে মরিয়মসহ অনেক রোহিঙ্গার ওপর মিয়ানমার বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ, জেনোসাইড, স্থলমাইন ব্যবহারের তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। সংস্থাটি গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর ধারাবাহিক ও ব্যাপক মাত্রায় নৃশংসতার তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিল। এবারের প্রতিবেদনে সংস্থাটি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে পঙ্গু করে দেওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ করেছে। এ দুটি প্রতিবেদন নিয়ে আগামী সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে যাচ্ছে পিএইচআর। জেনেভায় পিএইচআরের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লিরও রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে আলোচনা করার কথা।
এরপর মঙ্গলবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি সেদিন মানবাধিকার পরিষদে তথ্য-উপাত্তসহ সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরবেন এবং আলোচনা করবেন। ওই আলোচনার পর ১০ জুলাই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্ল্যাশেলেট।
পিএইচআরের এবারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার বাহিনীর হামলায় আহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশই গুলিতে ‘নিউরোলজিক্যাল ইনজুরির’ শিকার। ২১ শতাংশ রোহিঙ্গা দগ্ধ হয়েছে বিস্ফোরকে। এ ছাড়া ৯ শতাংশ ফ্র্যাকচার ও ব্যথায় ভুগছে। বাকি ৭ শতাংশ রোহিঙ্গা অঙ্গহানির শিকার।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে যখন পালিয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটছিল তখন তাদের মাইন পেতে রাখা এলাকার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ওপর গুলি চালিয়ে, অন্যান্য বিস্ফোরক ছুড়ে বা বেদম পিটিয়ে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবনযাপন করছে।
এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধগুলো বিশ্লেষণ করে পিএইচআর বলেছে, তাদের কাছে অন্তত ৪৩ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার বাহিনীর পঙ্গু করে দেওয়ার তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এ ছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী বক্তব্য ও বিদ্বেষ ছড়াতে এবং তাদের বাস্তুচ্যুত করতে সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের যে তৎপরতার তথ্য পাওয়া গেছে তা-ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘জেনোসাইড’ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে বলে পিএইচআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।