‘প্রত্যেক জাতির আমানতদার ব্যক্তি আছে। এই উম্মতের (মুসলিম জাতির) আমানতদার ব্যক্তি হচ্ছে আবু উবাইদা।’ (বোখারি: ৫/২৫) হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এমনটি এরশাদ করেছেন। এই শ্রেষ্ঠ আমানতদারের পুরো নাম আমির ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহ আল-ফিহরি, আল-কুরাইশী। তবে তিনি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ নামে অধিক পরিচিত। তার সপ্তম ঊর্ধ্বপুরুষ ‘ফিহরের’ মাধ্যমে তার বংশ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বংশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তার মাতাও ফিহরি খান্দানের ছিলেন।
হজরত আবু উবাইদা (রা.) হিজরতের ৪০ বছর আগে ৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল অবয়ব, গৌরকান্তি, হালকা-পাতলা গড়ন ও দীর্ঘদেহের অধিকারী। মুখে ছিল অঘন দাড়ি। সাক্ষাতে যে কারও হৃদয়ে ভালোবাসার উদয় হতো এবং চোখ জুড়িয়ে যেত। তীক্ষ্ন মেধাবী, অত্যন্ত বিনয় ও লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে তিনি মুসলমান হয়েছিলেন।
হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) এর মুসলমান হওয়ার পরের দিনই তিনি তার দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় মুসলমানদের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি শরিক ছিলেন। জুলুম-নির্যাতনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অটল থেকে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দুইবার হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হিজরতের পর তিনিও মদিনায় হিজরত করেন।
অনন্য মর্যাদায় বিভূষিতঃ
‘আশারায়ে মুবাশশারা’ তথা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবির অন্যতম হজরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি খেতাবে ভূষিত করেছেন। বর্ণিত আছে, একবার নাজরান থেকে খ্রিস্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে এসে আরজ করল হে আবুল কাসেম! আমাদের সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠান। যিনি আমাদের কিছু বিতর্কিত সম্পদের ফায়সালা করে দেবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে একজন প্রকৃত আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব। নবীজির এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যেকে কামনা করছিলেন যেন তাকে পাঠানো হয়। হজরত ওমর (রা.) বলেন, জীবনে শুধু সেদিনই আমি নেতৃত্বের জন্য লোভ করেছিলাম। এর একমাত্র কারণ ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রশংসার পাত্রটি যেন আমি হতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ পড়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাতে লাগলেন। আর আমিও তার নজরে আসার জন্য আমার গর্দানটি একটু উঁচু করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে এক সময় আবু উবাইদাকে দেখতে পেলেন। তাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তাদের সঙ্গে যাও এবং সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফায়সালা করে দাও।’ (তারিখে দামেস্ক : ২৫/৪৫৯)।
হজরত আয়শা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, সাহাবিদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে অধিক প্রিয়পাত্র কে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আবুবকর, তারপর ওমর ও আবু উবাইদা (রা.)।’ (নাসায়ি : ৮২০১)। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘কতই উত্তম ব্যক্তি আবুবকর, ওমর, আবু উবাইদা, উসাইদ বিন হোজাইর, সাবিত বিন কায়স, মোয়াজ ইবনে জাবাল এবং মোয়াজ ইবনে আমর ইবনে জামুহ (রা.)।’ (তিরমিজি : ৩৭৯৫)।
নবীজির সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণঃ
হজরত আবু উবাইদা (রা.) নবীজির সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে কোরাইশ কাফেলার গতিবিধি অনুসরণের জন্য রাসূল (সা.) একদল সাহাবিকে পাঠান। তাদের আমির নিযুক্ত করেন আবু উবাইদা (রা.) কে। এছাড়াও বেশ ক’টি সারিয়া যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে আমির নিযুক্ত করেছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে কাফেররা নবীজিকে লক্ষ্য করে তীরের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করলে তিনি বুক পেতে রাসুলকে আগলে রাখেন। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল নবীজির দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছে, কপাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এবং গ-দেশে বর্মের দুটি বেড়ি বিঁধে গেছে। হজরত আবুবকর (রা.) বেড়ি দুটি উঠানোর জন্য এগিয়ে এলেন। আবু উবাইদা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। তিনি ছেড়ে দিলেন। আবু উবাইদা (রা.) নিজের দাঁত দিয়ে শক্তভাবে কামড়ে ধরে বেড়ি দুটি উঠালেন। কিন্তু এতে তার দাঁত ভেঙে গেল। তখন আবুবকর (রা.) বললেন, ‘আবু উবাইদা সর্বোত্তম ব্যক্তি।‘ খন্দক, বনিকুরাইজা, খায়বার, মক্কাবিজয়, তায়েফ অভিযানসহ সর্বক্ষেত্রে তিনি রাসুলের সঙ্গী ছিলেন। হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক চুক্তিতে তিনি একজন সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন। বিদায় হজেও তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সফরসঙ্গী ছিলেন। মোটকথা ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সর্বক্ষেত্রে ছায়ার মতো সর্বদা তাঁকে অনুসরণ করেছেন।
খোলাফায়ে রাশেদা যুগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন
রাসুলের ওফাতের পর খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে যখন আনসারদের মধ্যে তুমুল বাকবিতন্ডা চলছিল, তখন আবু উবাইদা (রা.) তাদের লক্ষ্য করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি তাদের সতর্ক করে বলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরাই প্রথম সাহায্যকারী। আজ তোমরাই প্রথম বিভেদ সৃষ্টিকারী হয়ো না।’ এক পর্যায়ে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) আবু উবাইদা (রা.) কে বললেন, ‘আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি। আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি প্রত্যেক জাতির একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে। আর আপনি এ জাতির বিশ্বস্ত ব্যক্তি।’ জবাবে আবু উবাইদা (রা.) বললেন, আমি এমন ব্যক্তির সামনে হাত বাড়াতে পারি না, যাকে রাসুল (সা.) আমাদের নামাজের ইমামতির আদেশ করেছেন এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত যিনি ইমামতি করেছেন। এ কথার পর হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) এর হাতে বাইয়াত করা হলো। আবুবকর (রা.) খলিফা হওয়ার পর তিনি তার উপদেষ্টা ও সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেন। শামে অভিযান পরিচালনার জন্য হজরত আবুবকর (রা.) সেনাবাহিনীকে চারটি দলে বিভক্ত করে প্রত্যেক দলের পৃথক পৃথক অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। হজরত আবু উবাইদাকে হিমস, আমর ইবনুল আসকে ফিলিস্তিন, ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ানকে দামেস্ক এবং শুরাহবিল ইবনে হাসানাকে জর্ডানের দিক থেকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। এ সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন হজরত আবু উবাইদাকে। তার হাতেই শামের বিভিন্ন অঞ্চল বিজিত হয়। হজরত ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে তিনি সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। ওমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হয়েই ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদকে অপসারিত করে আবু উবাইদাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ছিনিয়ে আনেন। হজরত ওমরের কাছে তিনি এতই গ্রহণযোগ্য ছিলেন যে, মৃত্যুর সময় তিনি বলেছিলেন আবু উবাইদা বেঁচে থাকলে আমি তাকে আমার পরবর্তী খলিফা বানিয়ে যেতাম।’ (তারিখুল খোলাফা : ১/৫৫)।
অনাড়ম্বর জীবনের অনন্য নজির
খলিফা ওমর (রা.) সিরিয়া সফরের সময় দেখতে পেলেন অফিসারদের গায়ে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক। এতে তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, তোমরা এত তাড়াতাড়ি অনারব অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ? কিন্তু সিরিয়ার আমির আবু উবাইদা (রা.) সাদামাটা পোশাকে খলিফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। হজরত ওমর (রা.) তার বাসস্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন আরও বেশি সাদাসিধে জীবনধারার চিহ্ন। অর্থাৎ একটি মুসল্লা, একটি ঢাল ও উটের একটি হাওদা আর সামান্য কিছু রুটির টুকরো ছাড়া আর কিছু নেই। খলিফা ওমর বললেন, দুনিয়া আমাদের সবাইকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। কিন্তু হে আবু উবাইদা! তোমাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। (তারিখে দামেস্ক : ৪/৮০)।
একবার হজরত ওমর (রা.) উপঢৌকন হিসেবে ৪০০ দিনার ও চার হাজার দিরহাম আবু উবাইদার কাছে পাঠালেন। তিনি সব অর্থই সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। নিজের জন্য একটি পয়সাও রাখলেন না। হজরত ওমর (রা.) একথা শুনে মন্তব্য করলেন আলহামদুলিল্লাহ! ইসলামে এমন লোকও আছে।
১৮ হিজরি মোতাবেক ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৮ বছর বয়সে এ মহান সাহাবি জর্ডানে ইন্তেকাল করেন। সূত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ।