অবিশ্বাস্য এক গোলে লিওনেল মেসি এঁকে দেন ‘এল ক্লাসিকো’র গন্তব্য। ৩-২ গোলে জিতে স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপা রেসেও তাই প্রবল প্রত্যাবর্তন বার্সেলোনার। ম্যাচের শুরুর দিকের ঘটনা সেটি। প্রবল প্রতিপক্ষের কনুইয়ের আঘাতে রক্ত ঝরে তাঁর মুখ থেকে। আর ম্যাচের একেবারে শেষে? তিনি নিজেই রক্ত ঝরান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের হৃদয়ে! নির্ধারিত সময় পেরিয়ে; যোগ করা সময়ের মাত্র ১৩ সেকেন্ড বাকি থাকতে।
অথচ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে এই মহারণে গোলের দেখা পান না তিনি কত কাল! সময়ের হিসাবে তিন বছরের বেশি, ম্যাচের হিসাবে সর্বশেষ ছয় দ্বৈরথে। আর পরশুর ম্যাচের আবহেও তো বিষাদ-মেঘের ওড়াউড়ি। জুভেন্তাসের কাছে হেরে বার্সার ইউরোপ-অভিযান শেষ; ওই ইতালিয়ান ক্লাবটির বিপক্ষে দুই লেগের ১৮০ মিনিটে গোল করতে পারেননি মেসি কিংবা তাঁর কোনো সতীর্থ। তাতে বার্সার সাফল্যচক্রের শেষ দেখে ফেলেন অনেকে; আর্জেন্টাইন জাদুকরের ফুটবল-রাজত্বেরও।
তা ভুল প্রমাণ করতে পেরে মেসির অনুমেয় উল্লাসের কী অননুমেয় প্রকাশ! স্তব্ধ বার্নাব্যুর নিস্তব্ধ সমর্থকদের সামনে গিয়ে নিজের জার্সি খুলে তা দেখানোর কী রাজকীয় উদ্যাপন! যেন রাজ্যজয় শেষে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শিরস্ত্রাণ খুলে উৎসব। বিবর্ণ তারার মতো মিটমিটিয়ে জ্বলা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর বিপরীতে লিওনেল মেসির অমন ঝলসানো সৌন্দর্যেই তো প্রাণ ফিরেছে লা লিগার শিরোপা-রেসে।
এল ক্লাসিকো—দ্বৈরথটি অনেক দিন ধরেই ধ্রুপদী ফুটবলের বিজ্ঞাপন। নামকরণের সার্থকতায় পরশুর লড়াইয়ের ভাঁজে ভাঁজে রোমাঞ্চের উপাদান। বাঁকে বাঁকে রহস্যের উপকরণ। নাটকের চেয়েও নাটকীয় সেই ফুটবল-যুদ্ধে কী ছিল না! দুই বারপোস্টের নিচে দুই গোলরক্ষকের অবিশ্বাস্য সব সেভ; তবু আক্রমণাত্মক ফুটবলের দামামা বেজে ওঠা বার্নাব্যুতে পাঁচ গোল। রিয়াল মাদ্রিদের এগিয়ে যাওয়ার পর বার্সার ম্যাচে ফেরা; তাদের লিড নেওয়ার পর স্বাগতিকদের ১০ জনে পরিণত হওয়া। সের্হিয়ো রামোসের সেই লাল কার্ডেই তো ম্যাচ শেষ বলে ধরে নেন প্রায় সবাই।
কিন্তু বদলি হিসেবে নামা হামেস রোদ্রিগেসের গোলে রিয়ালের প্রবল প্রতাপে ফেরা। ফুটবল-রূপকথার নটে গাছ মুড়াতে পারত এখানেই; কিন্তু গল্পটা যে ফুরোয় না! ফুরোয় না মেসির পায়ে লেখা অবিশ্বাস্য শেষ অধ্যায়টির অপেক্ষায়। প্রতি আক্রমণে সের্হি রবার্তো আপাত নিরীহ জায়গা থেকে ঢুকে পড়েন বিপজ্জনক অঞ্চলে। আন্দ্রেও গোমেসকে বাড়ানো বলে তবু যেন ছিল না বিপদের বার্তা। রিয়াল মাদ্রিদের পেনাল্টি এরিয়ায় ইয়োর্দি আলবার পায়ে বল তুলে দেন ওই মিডফিল্ডার। এরপর ডিফেন্ডারের কাটব্যাক। বক্সের বাইরে থেকে চিতার ক্ষিপ্রতায় ভেতরে ঢুকে পড়ে সেই বলে মেসির বাঁ পায়ের ঐশ্বর্যমাখা এক স্পর্শ। কেইলর নাভাসের মরিয়া চেষ্টার পরও বলটির আদুরে আশ্রয় জালে।
তাতেই বার্সার উল্লাসের বিস্ফোরণ। তাতেই রিয়াল মাদ্রিদের স্বপ্নমঞ্চ বার্নাব্যুর বিষণ্নতার আঁধারে ডুবে যাওয়া। অথচ ম্যাচের শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষেই বাজির দল ছিল বেশি। হবে না? চ্যাম্পিয়নস লিগে সদ্যই বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়েছে। সেখানে রোনালদোর দুই লেগ মিলিয়ে পাঁচ গোলে তাঁর নামে দশ দিকে জয়ধ্বনি উঠছিল আবার।
অন্যদিকে বার্সা তো চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে সদ্য বিদায় নিয়েছেই। ‘এমএসএন’ ত্রিফলার নেইমারের নিষেধাজ্ঞা তোলার আবেদনে কাজ না হওয়ায় ওই ব্রাজিলিয়ানকে ছাড়াই নামতে হয়েছে খেলতে। কিন্তু সব ছাপিয়ে পরশু বার্নাব্যুর সন্ধ্যাটি হয়ে থাকে কেবলই মেসির। ২৮তম মিনিটে রামোসের শট পোস্টে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসার পর কাসেমিরো বল জালে জড়ালেও হতোদ্যম হননি তিনি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দলকে ফেরান সমতায়। দারুণ এক টিম মুভের পরিণতিতে ইভান রাকিটিচের কাছ থেকে বল পেয়ে চিতার চঞ্চলতায় ঢুকে পড়েন বক্সের। ডান পায়ের ছোট্ট কারুকাজে গোলমুখ খুলে বাঁ পা দিয়ে বল পাঠিয়ে দেন জালে।
প্রথমার্ধ শেষ হয় সমতায়। দ্বিতীয়ার্ধের অনেকটা সময়ও ওই সাম্যাবস্থা। তাই বলে রোমাঞ্চের কমতি ছিল না। শুধু গোলরক্ষককে পেয়ে অবিশ্বাস্য মিস করেন এদিকে রোনালদো, ওদিকে লুইস সুয়ারেস। আরো কত কত সুযোগ-অর্ধসুযোগ! অবশেষে ৭৩তম মিনিটে রাকিটিচের বাঁ পায়ের দুর্দান্ত গোলে এগিয়ে যায় বার্সা। এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মেসিকে জোড়া পায়ে ফাউল করে রিয়াল অধিনায়ক রামোস মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে খেলা চলে যায় পুরোপুরি বার্সার নিয়ন্ত্রণে।
পিকে-মেসির প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে নাভাস কোনো রকমে ম্যাচ টিকিয়ে রাখেন স্বাগতিকদের। আর বদলি হিসেবে নামা রোদ্রিগেস ৮৬তম মিনিটে যখন সমতাসূচক গোলটি করেন, সেটিকে মনে হচ্ছিল ধ্রুপদী মহারণের ক্যানভাসে তুলির শেষ আঁচড়।
কিন্তু শেষ স্ট্রোকটা তো জমা ছিল ওই মহান ফুটবলশিল্পীর জন্যই। লিওনেল মেসির অপেক্ষায়। তাঁর শেষ স্পর্শেই যেন পূর্ণতা পেল স্মরণকালের সবচেয়ে স্মরণীয় এল ক্লাসিকোর দ্বৈরথ। এএফপি, মার্কা