ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার পারদ আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সোমবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফসহ আট শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগেই অবশ্য ইরানকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বিস্ময়করভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনার প্রস্তাব দেন। তবে পর পর দুই দিনে ইরানের বিরুদ্ধে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতমুখী দুই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তেহরান। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের আচরণ কূটনৈতিক আলোচনার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে করে তারা। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ‘আপনি একই সঙ্গে আলোচনার জন্য ডাকছেন আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন। এর মানে হচ্ছে নিশ্চিতভাবেই মিথ্যাচার করছেন আপনি।’
এরই মধ্যে ইরান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চীন। তারা দুই পক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। আর জাতিসংঘ চাইছে, দেশ দুটি আর সময় নষ্ট না করে আলোচনায় বসুক। তবে তাদের এসব দাবিদাওয়া-চাহিদা আশু মেটার কোনো সম্ভাবনা নজরে আসছে না।
এদিকে ইরানবিরোধী এক বৈশ্বিক জোট গঠনের চেষ্টা হিসেবে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। পম্পেও আছেন সৌদি আরবে আর বোল্টন ইসরায়েলে। আলোচনার প্রস্তাব সম্পর্কে ইরানের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বোল্টন সোমবার বলেন, ‘তারা বধিরের মতো নীরব হয়ে গেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার প্রস্তাব এবং নিষেধাজ্ঞা জারি দুটি বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এই বৈঠকে রুহানি বলেন, ‘ওয়াশিংটন দ্বিধান্বিত। ইরানের (সর্বোচ্চ) নেতার সম্পদের মধ্যে রয়েছে একটি হোসেইনি (শিয়াদের প্রার্থনার স্থান) এবং একটি সাধারণ বাড়ি। অন্য দেশের মতো ইরানি নেতাদের বিদেশের ব্যাংক হিসাবে হাজার কোটি ডলার থাকে না। কাজেই এগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বা জব্দ করার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন কেন? যাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে না পারেন? খুবই বুদ্ধিদীপ্ত একটি সিদ্ধান্ত!’ তিনি আরো বলেন, ‘এই হোয়াইট হাউস মানসিক ভারসাম্যহীন।’
ট্রাম্প সোমবার খামেনি-জারিফ ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর আট শীর্ষ সামরিক নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের মূল পরিচিতি মধ্যপন্থী মানুষ হিসেবে। পরমাণু চুক্তি আলোচনায় তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ইরানের ক্রমবর্ধমান উসকানিমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এটি জোরালো ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। আমরা সংঘাত চাই না।’ তিনি বলেন, ইরানের আচরণের ওপর নির্ভর করবে এই নিষেধাজ্ঞা আগামীকাল প্রত্যাহার করা হবে নাকি সামনের বহু বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এমনিতেই দুটি দেশের মধ্যে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর থেকেই সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। গত বছর ইরানের পরমাণু অস্ত্র চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান। এর পরই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিল যুক্তরাষ্ট্র।
শুধু রুহানিই নন, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মৌসাভি গতকাল বলেন, ‘ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং প্রধান কূটনীতিকের ওপর অর্থহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কূটনৈতিক পথে সমাধানের সম্ভাবনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।’ এক টুইটে তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখার সব আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কৌশল ধ্বংস করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। চীন দুই পক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, ‘আমরা মনে করি, অন্ধভাবে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, এ ধরনের ব্যবস্থা বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং আঞ্চলিক অশান্তিকে আরো বাড়িয়ে দেয়।’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে। পৃথক বার্তায় একই কথা বলেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। সূত্র : এএফপি।