১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ সকাল বেলা। ভ্যাপসা গরম লাগছিল তখন, পূর্ব আকাশে দেখা গেল উড়ছে কিছু শকুন। মনে হল অশনি কোন কিছুর আভাস।
এমন সময় দেখা গেল পদ্মা নদীর উপর নির্মিত বাঁধের উপর টহল দিচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। মনের ভয় বুঝি বাস্তবিক পক্ষেই সংক্রমিত করল আমাকে। মনে হচ্ছিল আকাশের উড়ন্ত শকুনগুলোই বুঝি সড়কপথে গাড়িতে করে চলেছে।
টহল গাড়িগুলো হঠাৎ করেই থামল রাজশাহীর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অফিসের গেটে। পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে পিওন, ঝাড়ুদার সবাই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল । শহরটি তখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পাক সৈন্যরা সব ক্যান্টনমেন্টেই তখন ঘেরাও অবস্থায়।
১৩ এপ্রিল কামান বন্দুকের শব্দ শোনা যাচ্ছিল অনেক। শুনলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে নগরবাড়ী সড়কে পাক সৈন্যরা ঢাকা থেকে অগ্রসর হয়েছে, রাতেই নাকি তারা রাজশাহী পৌঁছেছিল। কিন্তু আমরা জানতে পারিনি তা।
তড়িঘড়ি করে ১৮-২০ জন পাকিস্তানি সেনা ঢুকে পড়ল অফিস চত্বরে। পাকিস্তানি সেনারা প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে ঢুকে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণ-গয়না লুট করছিল। মনে হচ্ছিল বনের পশুরা হানা দিয়েছে। সবকিছু তছনছ করছিল। উপস্থিত পুলিশ অফিসারদেরকে জেরা করছিল অকথ্য ভাষায়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের হুংকার-‘কোই হাতিয়ার”।
পুলিশ সুপার খোন্দকার আবু আকতার ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমানকে নির্দেশ দিলেন গার্ডদের পরিত্যক্ত রাইফেলগুলো বের করে দিতে।
পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্দেশে একজন অবাঙালি সিপাহি রাইফেল ও বন্দুকগুলো গাড়িতে তুলল। কেউই জানে না কি অপেক্ষা করছে, কী ভীষণ বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা হতে যাচ্ছে কিছুক্ষন পরে।
পুলিশ অফিসারসহ সবাইকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসল পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের দাঁড় করানো হলো দুই সারিতে। সামনের সারিতে পুলিশ সুপার খোন্দকার আবু আকতার ও ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমান। পিছনের সাড়িতে ছিলেন ইন্সপেক্টর আজিজুল হক, একজন পিওন এবং পুলিশ সুপারের কাছে আসা একজন মেহমান।
হঠাৎ শুনতে পেলাম মেশিনগানের প্রচন্ড শব্দ, সাথে সাথেই গগনবিদারী আর্তনাদ । রক্তমাখা অবস্থায় খোন্দকার আবু আকতার এবং আজিজুর রহমানের নিথর দেহ পড়ে রইল। বাকি তিনজন গুরুতর আহত অবস্থায় রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল। ভয়ে সবাই বিমূঢ়। পড়ে থাকা দু’টি লাশের কাছে কেউই এগিয়ে গেল না।
পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুন দিয়ে পোড়াতে শুরু করল হাট-বাজার, গ্রামের পর গ্রাম। কারফিউ ও শুরু হয়ে গেল। আকতার সাহেবের গুলি লেগেছিল চোয়ালে। সুন্দর মুখশ্রীর ব্যক্তিটির মুখমন্ডলের কি বিভৎস দশা। তাঁর লাশ খেতে শুরু করল কাক-কুকুর।
১৫ই এপ্রিল সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা কিছু সংখ্যক অবাঙালির সহায়তায় লাশগুলোকে মাটিচাপা দিল, যদিও তাদের হাত, পা, দেহের কিছু মাটির বাইরেই ছিল।
কারফিউ শেষ হল ১৭ এপ্রিল। হুকুম আসল-অফিস ছেড়ে সবাইকে যেতে হবে। আমি আমার দুই ছেলে ও মেয়ে নিয়ে সাগরপাড়ায় বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু আসার পথে দেখতে পেলাম কুকুরে খাওয়া পঁচা লাশ ও এক হিন্দু ব্রাহ্মণের তরতাজা লাশ ।
শুরু হলো ত্রাসের রাজত্ব !
মূল লেখা : ‘ভুলতে পারি না সেদিন’, বেগম আনোয়ারা রহমান, শহীদ ইন্সপেক্টর মোঃ আজিজুর রহমানের বিধবা পত্নী
অনুলিখন : সুব্রত দাস