ঐতিহ্য, ইতিহাস, স্থাপত্যকীর্তি এবং শিল্পশৈলীর নিদর্শনসমৃদ্ধ কুমিল্লা জেলার দিগন্ত প্রসারিত সবুজ ভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বনানীঘেরা এ অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি।
প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্রীড়াভূমি কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি অঞ্চল।
জানা গেছে, লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে কমপক্ষে ৬টি রাজবংশের ৩৪ জন রাজার রাজত্বকালের অনেক কীর্তির চিহ্ন উন্মোচিত হয়েছে। এসব প্রাচীন কীর্তি আমাদের জাতীয় জীবনের সম্পদ, পরম গৌরবের বস্তু। এ পাহাড় ঘিরে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব ভাণ্ডার, বিভিন্ন রাজবংশের প্রাচীন কীর্তি, অর্ধশতাধিক মুড়া বা টিলা, অসংখ্য প্রাচীন দীঘি-পুষ্করিণী, সেনানিবাস, বিজিবি সদর দফতর, মসজিদ-মাজার, মন্দির, বিশ্ববিদ্যালয় ও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও পর্যটন কেন্দ্র।
দেশ-বিদেশের পর্যটক ছাড়াও এখানে শিক্ষাসফর/বনভোজনে আসেন দূর-দূরান্তের স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জ্ঞানপিপাসুরা। ফলে এ পাহাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান ও জীবন-জীবিকার অবলম্বনও লালমাই-ময়নামতি পাহাড়।
লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের অবস্থান : ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রায় মাঝামাঝি অংশে কুমিল্লা মহানগরীর প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দীর্ঘ যে অনুচ্চ ও সরু পাহাড়শ্রেণি আছে এর দক্ষিণ ভাগ ‘লালমাই’ ও উত্তর ভাগ ‘ময়নামতি’ পাহাড় নামে পরিচিত। জেলার আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, বুড়িচং ও বরুড়া উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের অবস্থান। পাহাড় ও পাহাড়সংশ্লিষ্ট এলাকায় অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রাম রয়েছে। প্রায় ৩৩ বর্গকিলোমিটারের এই পাহাড়শ্রেণি ১৯ কিলোমিটার লম্বা এবং প্রায় আড়াই কিলোমিটার প্রশস্ত। পাহাড়ের উত্তর দিকের শেষ প্রান্তে পাহাড়চূড়ায় আছে রাণী ময়নামতির প্রাসাদ এবং দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে পাহাড়চূড়ায় রয়েছে চন্ডীমুড়া মন্দির। ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পাহাড় ভেদ করে চলে গেছে। ময়নামতি পাহাড়ের প্রায় সকল অংশ ও লালমাই পাহাড়ের কিছু অংশ নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে কুমিল্লা সেনানিবাস।
রাজাদের রাজত্বকালের নিদর্শন: লাল মাটিতে গঠিত প্রাচীন ভূমির গঠন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বেশিরভাগ ভূ-তত্ত্ববিদ মনে করে প্রায় ১৮ লাখ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে শুরু হয়ে প্রায় ১০ হাজার বছর আগেকার হলোসিন যুগে ভূ-গাঠনিক আন্দোলনজনিত কারণে বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের মতো কুমিল্লা লালমাই ও ময়নামতি প্রভৃতি এলাকার ভূমি সৃষ্টি হয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজনের দেওয়া তথ্য ও বিভিন্ন বই ঘেঁটে জানা যায়, লালমাই-ময়নামতি পাহাড়শ্রেণির প্রায় সমগ্র এলাকা জুড়ে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির অস্তিত্ব রয়েছে। রয়েছে অর্ধশতাধিক মুড়া বা টিলা। অসংখ্য প্রাচীন কীর্তি বা কীর্তির ধ্বংসাবশেষও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রাণী ময়নামতির প্রাসাদ বা দুর্গ, সেনানিবাসের হাসপাতালের (সিএমএইচ) মুড়া, আনন্দ রাজার বাড়ী, চারপত্র মুড়া, নীলাচল পাহাড় ইত্যাদি।
প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু: লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে এ যাবত্কালে অসংখ্য মূল্যবান প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে এবং উন্মোচিত হয়েছে প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১২টি তাম্রশাসন, ৪ শতাধিক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর নির্মিত মূর্তি, মাটির তৈরি অসংখ্য নিবেদন স্তূপ ও সিল, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক (টেরাকোটা), স্বর্ণ-রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ নির্মিত অলংকার, মূল্যবান পাহাড়ের গুটিকা, প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র, ধাতু ও মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি। লালমাই পাহাড়ি এলাকা ও এর আশপাশে অসংখ্য প্রাচীন দীঘি-পুষ্করিণীর অস্তিত্ব দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দ্যুতিয়ার দীঘি, সুঙ্গ দীঘি, মহীর দীঘি, জয়ঠমের দীঘি, হবলুয়া দীঘি ইত্যাদি।
আদিনামুড়া: লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে আদিনামুড়া পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত হযরত ওয়ায়েছ করনী (রহঃ) এর আস্তানায়ে শাহ কামাল ইয়্যামনী (রহঃ) এর মাজার শরীফ। বর্তমানে এই মাজার শরীফে অনুষ্ঠিত বাত্সরিক উরশ মাহফিলে ভারত এবং দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার ভক্ত অংশগ্রহণ করে থাকেন।
চন্ডিমুড়া মন্দির: জেলার লাকসাম, বরুড়া ও সদর দক্ষিণ উপজেলার ত্রিমুখী মিলনস্থলে লালমাই পাহাড়চূড়ায় ২ একর ৬৮ শতক জায়গা জুড়ে চন্ডি ও শিব নামক দুটি মন্দির অবস্থিত। চন্ডিমন্দিরের নামানুসারে এলাকাটি চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিত। ত্রিপুরাধিপতির বংশধর দ্বিতীয়া দেবী প্রতিষ্ঠিত চন্ডি মন্দিরদ্বয় ১৩শ’ বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি: ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান, জাপানী, আমেরিকান, ভারতীয় ও নিউজিল্যান্ডের ৭৩৭ জন সৈন্যের সমাধিস্থল এটি। কুমিল্লা মহানগর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সেনানিবাস সংলগ্ন ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নৈসর্গিক পরিবেশে অবস্থিত ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। কমনওয়েলথ গ্রেভ ইয়ার্ড কমিশন এ যুদ্ধ সমাধি ক্ষেত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস: পাহাড়ের কোটবাড়ি, সালমানপুরসহ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। হাতে গোনা কয়েকটি থেকে বর্তমানে শতাধিক উপজাতি পরিবার রয়েছে এ পাহাড়ি এলাকায়। তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিয়ে, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিকতায় রয়েছে ভিন্নতা। এ পাহাড় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর অভয়ারণ্য। খবর ইত্তেফাক।