ডিএমপি নিউজঃ ব্যাংক কর্মকর্তা আসলাম সাহেবের কথায় বোঝা গেল কতটা অসহায় তিনি। বলছিলেন তার ৫ বছর বয়সের ছেলে আতিফের কথা। তিনি অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই আতিফ ছুটে এসে রীতিমত ছিনিয়ে নেয় মোবাইল। শুরু হয় মোবাইলে গেম খেলা। সারাদিন মায়ের মোবাইলে গেম খেলে, ইউটিউব দেখেও তার তৃপ্তি হয়না। শত বোঝালেও কাজ হয়না, মানা শুনতে চায়না আতিফ। চিৎকার কান্নাকাটি করে সারা ঘর মাথায় তোলে। স্কুলের সময়টা ছাড়া আতিফের দিন কাটে এভাবে মোবাইলে গেম খেলে অথবা টিভি দেখে। দিনকে দিন আসক্তি বাড়ছে আর খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ব্যাপারটা ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে আসলাম দম্পতিকে।
পাঠক, আসলাম সাহেবের মত এমন সমস্যায় হয়তো পড়েছেন আপনি অথবা আপনার কাছের কেউ। সাম্প্রতিককালে শিশুদের মাঝে বিভিন্ন ডিজিটাল স্মার্ট ডিভাইস যেমন মোবাইল, ট্যাব, প্লেস্টেশন ইত্যাদির প্রতি এমন অতিরিক্ত আসক্তির বহু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বহু বাবা-মা’ই তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। আশীর্বাদ হবার জায়গায় আতংক হয়ে পড়ছে কেন স্মার্ট ডিভাইস? এর কারণ কি? কিভাবে মিলবে সমাধান? আসুন জানার চেষ্টা করা যাক।
শিশু যখন বেড়ে ওঠে তখন সে প্রভাবিত হয় তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং কি ধরণের সুযোগ সে পাচ্ছে তার উপর। এজন্য শিশুকে শেখাতে হয় আনন্দের পরিবেশের মধ্য দিয়ে। এ আনন্দ দানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে খেলাধুলা। শিশুদের সঠিক মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নগরজীবনে খেলার সুযোগ সুবিধার বড়ই অভাব। সারাদিন ঘরবন্দী বাচ্চাদের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠছে তাই স্মার্টফোন, প্লে স্টেশন, গিয়ার বক্স ইত্যাদি। তার শৈশব বন্দী হয়ে পড়ছে মনিটরের পর্দায়। পেশাজীবী বাবা-মা’র ব্যস্ততা অন্য একটি কারণ। সন্তানের সাথে গল্প করা, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, তাকে কিছু ‘কোয়ালিটি টাইম’ দেয়া এসবকিছু বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক। কিন্তু পেশাগত কাজে ব্যস্ত মা-বাবারা সে সময়টুকু সন্তানদের দিচ্ছে কোথায় ! ফলাফল স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি সন্তানদের ঝুঁকে পড়া। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে মা-বাবার নিজেদেরই অতিরিক্ত স্মার্টফোন আসক্তি। শিশু স্বভাবতই মা-বাবাকে অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে খোদ মা-বাবা যদি এ ধরনের যন্ত্রের প্রতি আসক্ত হয়ে যায়, তাহলে সন্তানও আসক্ত হবে এটা খুব স্বাভাবিক। আরো রয়েছে মেলামেশার সুযোগের অভাব। এপার্টমেন্ট কালচারে বড় হওয়া শিশুদের ‘সমাজ’ ওই সদর দরজার এপাড়েই। স্কুল ছাড়া সমবয়সী অন্য কারো সাথে মেশার সুযোগ তার কম। নিজের কথা বলার, চিন্তা শেয়ার করার সঙ্গী পাচ্ছে না সে। ফলে নিজে নিজে একটা জগত তৈরী করে তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। সে জগত তৈরীতে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে স্মার্ট ডিভাইস।
পরিত্রাণের উপায় ভাবতে হবে খুব বেশি দেরী হবার আগেই। শিশু যখন বুঝতে শেখে তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাকে সমবয়সীদের সাথে মেশার সুযোগ দিতে হবে। ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে অনেকের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার। খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা বড় প্রয়োজন। এতে শিশুর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। ইনডোর ও আউটডোর দুধরণের খেলার ব্যবস্থা রাখা যায়। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া যায় কোন পার্কে বা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যসম্পন্ন জায়গায়। মা-বাবা যত ব্যস্তই হোক সন্তানের জন্য সময় বের করতেই হবে। সন্তান যেন মনে না করে তার গুরুত্ব মা-বাবার কাছে কম। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবারের সদস্যদের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক একটি উত্তম প্রভাবক। কমাতে হবে মা-বাবা’র নিজেদের স্মার্টফোনে আসক্তিও। আগেই বলেছি শিশুরা যা দেখে তা-ই অনুসরণ করে। অতএব মা-বাবাকেও শিশুদের সামনে প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত এসকল ডিভাইস ব্যবহার করা অনুচিত। সব শেষে বলা যেতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এটি অত্যন্ত সুঅভ্যাস। বইয়ের মলাটবন্দী জ্ঞানের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে শিশুদের। ফলে সে অনুধাবন করতে পারবে বিনোদনের উৎস শুধু স্মার্ট ডিভাইসের রঙ্গিন পর্দা নয়, সাদা কালো অক্ষরের ভাঁজে ভাঁজেও আছে আনন্দ, রোমাঞ্চ।
অস্বীকার করার উপায় নেই এযুগে স্মার্ট ডিভাইস ছাড়া আমাদের চলা কঠিন। সময়ের সাথে শিশুরাও বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার শিখবে। কিন্তু অভিভাবককে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে এ ব্যবহার যেন পরিমিত হয়, কোনোক্রমেই যেন বিনোদনের একমাত্র উৎস না হয়। শিশুকে সুন্দর সুস্থ শৈশব উপহার দিতে ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপনে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল’ এর ভার তো আমদেরকেই নিতে হবে।