ডিএমপি নিউজ : বাঙালি জাতির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হওয়া মাসব্যাপী এ মেলা চলে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত। দর্শনার্থী, লেখক ও প্রকাশকদের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে উঠে বইমেলা। সাহিত্য প্রেমীদের এই মেলায় পিছিয়ে নেই পুলিশ সদস্যরাও। দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়ে সার্বক্ষণিক জনসেবায় থেকেও সাহিত্য জগতে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন পুলিশ সদস্যরা। কেউ লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, কবিতা, কেউবা আবার লিখেছেন গোয়েন্দা কাহিনী, কেউবা গীতিকবিতা। তাদের মননশীল লেখনী দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন পাঠকচিত্তে।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টল। এই স্টলে বইপ্রেমী পাঠকরা পাবেন পুলিশ বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সদস্যদের লেখা গ্রন্থসমূহ।
বইগুলো আপনার সংগ্রহে রাখাতে চাইলে বইমেলা চলাকালে যে কোন সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টল থেকে ঘুরে আসতে পারেন। অন্যান্য প্রকাশনীর স্টলেও পাওয়া যাচ্ছে বেশকিছু বই।
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বিপিএম, পিপিএম রচিত গ্রন্থ ‘পুলিশ জীবনের স্মৃতি, স্বৈরাচারের পতন থেকে জঙ্গি দমন’ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে এবার প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ১৮ নম্বর প্যাভেলিয়নে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) স্টলে পাওয়া যাচ্ছে বইটি। লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন সেই সব পুলিশ সদস্যের প্রতি যাঁরা জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে গেছেন
একালের পুলিশ সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় লেখক হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। বর্তমানে তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর রচিত মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ ‘ঠার’ পাঠকচিত্তকে আজও নাড়া দেয়। বইটি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ঠার ভাষা নিয়ে রচিত গ্রন্থ। তাঁর এই গ্রন্থটিতে দেশের বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার উদ্ভব, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় ভাষাটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক ধারণা পাওয়া যায় এতে। বইটি গত বছর বইমেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের ব্যানারে প্রকাশিত হয়। এবারের বইমেলায় তার নতুন দুইটি বই পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। বই দুটি হলো কারাগার থেকে লেখা বঙ্গবন্ধুর পত্রাবলী নিয়ে সম্পাদিত ‘চিঠিপত্র: শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং এর ইংরেজি সংস্করণ ‘Letters of Sheikh Mujibur Rahman’। তাঁর রচিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ ও নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’।
এস এম মোস্তাক আহমেদ খান বিপিএম, পিপিএম (বার) এ সময়ের সুপরিচিত পুলিশ লেখকের মধ্যে একজন। তিনি ডিআইজি হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত রয়েছেন। তিনি একজন বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি উপন্যাস থেকে শুরু করে ক্রাইম ফিকশন, ডিটেকটিভ সাইন্স ফিকশন, ভূতগল্প, কিশোর মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। এবারের বইমেলায় অনিন্দ্য প্রকাশনীর ব্যানারে তাঁর তিনটি উপন্যাস বের হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সায়েন্স ফিকশন ভিত্তিক উপন্যাস ‘নিতিনা’, ভৌতিক থ্রিলারের উপন্যাস ‘ছায়াআত্মা’ ও প্যারাসাইকোলজি থ্রিলারের উপন্যাস ‘স্বপ্নখুনি’। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘নক্ষত্রের রাজারবাগ’। বইমেলায় এ লেখকের ১২৪টি বই পাওয়া যাচ্ছে।
ষাটের দশকের পুলিশের জনপ্রিয় প্রবন্ধকার ও সাহিত্যিক সা’দত আলি আখন্দের আত্মজীবনী নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘তেরো নম্বরে পাঁচ বছর’। এটি ষাটের দশকে দুই বাংলার পাঠক সমাজে জনপ্রিয় ছিল। গ্রন্থটি ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও চাঞ্চল্যকর অসংখ্য ঘটনার একটি মূল্যবান দলিল। তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সব রচনা ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে সা’দত আলি আখন্দ রচনাবলী (২০০৯) নামে প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি ১৯৯০ সাল থেকে ‘সা’দত আলি সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করছে। তার জন্ম ১ জুলাই ১৮৯৯ সালে বগুড়া জেলার সদর থানার অন্তর্গত চিংসাপুর গ্রামে। তিনি পুলিশ বিভাগে দারোগা পদে ৩৩ বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৫৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ১২ মে বগুড়ায় এই বিখ্যাত সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।
বইমেলায় আরো পুলিশ লেখকদের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ফাতেমা বেগমের পেশাগত স্মৃতিচারণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই ‘আমার পুলিশ হওয়া’, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি মোঃ তওফিক মাহবুব চৌধুরীর মানুষের কথা বিশ্লেষণ করে সত্য-মিথ্যা বের করার পদ্ধতি নিয়ে রচিত বই ‘আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ’, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি শামীমা বেগম বিপিএম, পিপিএম-এর বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ ‘জীবন স্তব্ধ জেগে ওঠে শব্দ’, ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের পুলিশ সুপার শ্যামল আব্দুল হালিমের ভ্রমণ বিষয়ক বই ‘বান্দরবানের ঝর্ণা বিলাস’, উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-রমনা বিভাগ) জয়নুল আবেদীন রচিত সঙ্গীত গ্রন্থ ‘মনকবি মিউজিক’ কথা ও সুর ১ম খণ্ড। পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান শেলীর সায়েন্স ফিকশন নিয়ে লেখা বই ‘আমি এলিয়ন’, নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের বাংলা কবিতার বই ‘নির্জন শোভাযাত্রা’, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাখের হোসেন সিদ্দিকীর সায়েন্স ফিকশন ‘মহাবিস্ফোরণ ও সময়ের ভুল হিসাব’, ফরিদা রানুর কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসা কথা কয়’ এবং ‘বৃষ্টি ও সে’, মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘তোমায় দেব শিশির বিন্দুর নাকফুল’, মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসীন পিপিএম-এর আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন নিয়ে লেখা বই ‘হ্যালো পুলিশ স্টেশন’, সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক শাহীন ওমরের লেখা বাংলা কবিতার বই ‘বৃন্তচ্যুতির কোরাস’। রনো খন্দকারের রম্য রচনা ‘রকমারি রম্য এবং তামাম তামাশা’।
ইতোপূর্বে, পুলিশের যেসকল সদস্য বাংলা সাহিত্যের পাতায় তাঁদের নাম স্বার্ণাক্ষরে লিখে গেছেন তাদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। তাঁর বিখ্যাত বই ‘যখন পুলিশ ছিলাম’। এটি তাঁর অভিজ্ঞতা নির্ভর স্মৃতিচারণমূলক বই। ধীরাজ ভট্টাচার্যের কথা কার না জানা, সেই ঐতিহাসিক মাথিনের কূপের কথা উঠলেই উঠে আসে তার নাম। তাঁর জন্ম ১৯০৫ সালে যশোরে, মারা যান কলকাতায়। ছোটবেলা থেকেই গোয়েন্দা আর রহস্য গল্প-উপন্যাসের পোকা ধীরাজ পুলিশ হতে চাননি, চেয়েছিলেন সিনেমার নায়ক হতে। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক চলচ্চিত্র ‘সতীলক্ষ্মী’ (১৯২৫)-তে এক বখাটে ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ খবর পৌঁছে যায় তাঁর বাবার কানে। ছেলেকে সেখান থেকে এনে দিলেন পুলিশে, এএসআই পদে। প্রশিক্ষণের পর চট্টগ্রামে চাকরি করতে এলেন ধীরাজ। গোয়েন্দার চাকরি। স্বদেশীদের অনুসরণ করাই তাঁর কাজ। তাঁর আত্মজৈবনিক দুটো বইয়ের মধ্যে আরেকটি হলো, ‘যখন নায়ক ছিলাম’। মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য।
পুলিশের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক আবু ইসহাক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। জন্ম শরীয়তপুর জেলার শিরঙ্গল গ্রামে ১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর। তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বিএ পাস করেন। আবু ইসহাক প্রথমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শক পদে যোগ দেন। দেশবিভাগের পরে ১৯৪৯ সালে তিনি পুলিশ বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হন এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় এসে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার উপ-পরিচালক নিযুক্ত হন। পরের বছর মিয়ানমারের আকিয়াবে বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাসে ভাইস-কনসাল এবং ১৯৭৬ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের প্রথম সেক্রেটারি পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার খুলনা বিভাগের প্রধান হয়ে ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন আবু ইসহাক।
বিখ্যাত ‘পুরুষ’ গল্পের রচয়িতা আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। তিনি ১৯৩৪ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার লাকসামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। পরে তৎকালীন সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি ভারপ্রাপ্ত আইজির দায়িত্ব পালন করেন। অধুনালুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি জীবনের শেষ ভাগে বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন।
জনপ্রিয় কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক বেদুঈন সামাদ ছিলেন যশোর শহরের বেজপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। এই খ্যাতিমান সাহিত্যিক ১৯২৬ সালের ১ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি থানার অন্তর্গত ভবানিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেদুঈন সামাদ ছদ্মনামে অধিক পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম আবদুস সামাদ। ১৯৬৯ সালে তিনি খুলনা মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শিক্ষাজীবনে তিনি নানা ম্যাগাজিনে কবিতা লেখেন। পরে ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে পুলিশ বিভাগে চাকরিকালে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে।
পেশা যাই হোক, যেকোনো মানুষের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভা থাকতে পারে। পেশা কখনো সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারেনা। কর্মব্যস্ত পুলিশ গান লিখে, কবিতা লিখে, গল্প লিখে, কল্পকাহিনী লিখে। তাদের অনেকেই লেখনীর মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে।
বাংলা সাহিত্যে পুলিশের অবদান দিন দিন বেড়েই চলেছে। সময় এসেছে সাহিত্যে পুলিশের অবদান নিয়ে গবেষণা করার। সাহিত্য চর্চায় পুলিশের সরব ভূমিকা চলুক নিরন্তর।
বাংলা সাহিত্যাকাশে চিরকাল পুলিশি লেখনী ধ্রুবতারার মতো জ্বাজ্জল্যমান থাকুক।