স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করত। গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের এই পর্যবেক্ষণ সংরক্ষণ করত বঙ্গবন্ধুর নামে খোলা একটি ফাইলে। সেই গোয়েন্দা নথিগুলোর সংকলন নিয়ে এবার প্রকাশিত হলো ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক একটি বই।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে ১৪ খণ্ডের এই সংকলনের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সংকলন প্রকাশ করছে হাক্কানী পাবলিশার্স।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, যে নামটা একেবারে মুছে ফেলে দিয়েছিল। সত্যকে কখনো মিথ্যা দিয়ে চাপা দেওয়া যায় না, সেটাই আজ প্রমাণ হয়েছে। আর এই নাম আজ শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বে আজ উজ্জ্বল। আজকে বিশ্ব ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ইতিহাসকে জানবে। ইতিহাসের পথ ধরেই আমরা সামনে এগিয়ে যাব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যা করে গেছেন তার অনেক কিছুই আমরা এই রিপোর্টের মধ্য দিয়ে পাব। এই রিপোর্টগুলো তাঁর পক্ষের কিছু না। সবই তাঁর বিরুদ্ধের রিপোর্ট। কিন্তু এই বিরুদ্ধের রিপোর্টগুলোর মধ্যে থেকেই মনে হয় আমরা সব থেকে মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করতে পারব। যেমন—কয়লার খনি খুঁড়ে খুঁড়ে তার মধ্যে থেকে হীরা বের হয়ে আসে, হীরার খনি পাওয়া যায়। আমার মনে হয়েছে ঠিক সেভাবেই যেন আমরা হীরার খনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। বইটি সকলের হাতে তুলে দিতে পারলাম যেন বাংলাদেশের মানুষ সব জানতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বইটি প্রকাশের পেছনের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল, এই নামে তিনি একটা ডায়েরি লেখেন। আপনারা জানেন আমার মা সব সময় জাতির পিতাকে ডায়েরি লেখার বিষয়ে উৎসাহিত করে এসেছেন। তিনি খাতা কিনে কিনে দিয়ে আসতেন আবার খাতাগুলোকে উদ্ধার করে নিয়েও আসতেন। এসবি রিপোর্টে আমি পড়েছিলাম যে সেখানে দুই খানা খাতা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী তখন এসবির ডিজি। আমি তাঁকে বললাম, আমার বাবার দুটো খাতা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটা খুঁজে পাওয়া যায় কি না দেখতে হবে। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তিনি একদিন আমাকে একটা সুন্দর করে কাগজে মোড়ানো বই নিয়ে এসে বললেন, আপনার জন্য একটা উপহার আছে। আমি ভাবলাম বইটই হবে। আমি খুলে দেখে চোখের পানি রাখতে পারিনি। সেই খাতাখানা আমার হাতে তুলে দিলেন। বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে খাতার ওপরে লেখা ছিল, পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু লেখা ছিল সে জন্য বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখন তো আর পাকিস্তান আমল নাই সে জন্য আমরা এগুলো প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রায় ৪৬টি ফাইল। ৪০ হাজারের মতো পাতা। বসে সেগুলোকে এডিট করে করে, যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে আমরা আজকের এই প্রকাশনাটা করতে পেরেছি। আমি বলব এখানে অমূল্য তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট, এগুলো সবই জাতির পিতার বিরুদ্ধে। এই বিরুদ্ধের রিপোর্ট কেন আমরা প্রকাশ করলাম তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে। আমি জানি না পৃথিবীতে কোথাও কোনো দেশে কোনো নেতার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলে তা প্রকাশ করেছে কি না। আমার মনে হয় আজ পর্যন্ত কেউ বোধ হয় করেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার আগ্রহ এই কারণে যে এই রিপোর্টের মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকাণ্ড, গতিবিধি, তিনি কোথায় গিয়েছেন, কী করেছেন, তার অনেক তথ্য সেখানে আছে। আর যে সমস্ত চিঠিপত্র তাঁর কাছে গেছে তার অধিকাংশই বাজেয়াপ্ত করা ছিল। অনেক চিঠি তিনি দিয়েছেন সেগুলো হয়তো প্রাপকের কাছে কোনোদিনই পৌঁছায়নি। কিন্তু সে চিঠিগুলো এখানে পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের যে সংগঠনটা ১৯৪৯ সালে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখানে আওয়ামী লীগের পুরনো অনেক নেতাকর্মীর নাম পাওয়া যাচ্ছে। জাতির পিতা তাদের কাছে চিঠি লিখেছেন। ১৯৬৬ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়েও তথ্যগুলো আছে। আমরা সবই এগুলো প্রকাশ করছি।’
গোয়েন্দা নথিগুলোর দুরূহ পাঠ উদ্ধারে কাজ করায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাই তৎকালীন এসবির ডিজি বর্তমানে আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এবং তাঁর ২২ জনের টিমকে। তাঁদের সঙ্গে আমি অনুষ্ঠান শেষে ছবি তুলব। তাঁরা পুলিশে চাকরি করেন, কিন্তু আমি তাঁদের ওখান থেকে নড়তে দেই নাই, বলেছি এই কাজই করতে হবে। তাঁদের পেশাগত জীবনে যাতে ক্ষতি না হয় সেটা আমি দেখব। তাঁরা কাজ করতে করতে তাঁদের ভেতরে এমন একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল যে তাঁরাও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতেন।’
বইটির প্রকাশনা সংস্থা হাক্কানী পাবলিশার্সের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আশা করি আমাদের পাবলিশার্স বাকি খণ্ডগুলো দ্রুত প্রকাশ করে ফেলবে। আমরা ১৪ খণ্ডে এটা শেষ করব।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠানে মঞ্চে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম(বার),বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান, ট্রাস্টের সদস্যসচিব শেখ হাফিজুর রহমান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং হাক্কানী পাবলিশার্সের প্রকাশক গোলাম মোস্তফা। সূত্রঃ কালেরকন্ঠ