যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড রাজ্যের চেয়ে খানিকটা বড় ভুটানের অতীত যেমন সমৃদ্ধ, ভবিষ্যৎও ঠিক তেমনি উজ্জ্বল। এ উপমহাদেশের ওপর দিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির ঝড় বয়ে গেলেও ভুটান কখনো পরাধীন ছিল না। দেশটি জাতিসংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় আরো পরে, ১৯৭৪ সালে। বিশ্বে ভুটানই প্রথম জাতীয় সুখের সূচক চালু করে। ২০০৮ সালে তাদের ওই ঘোষণা পুরো বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভুটানে সুখী মানুষের সংখ্যাও অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। যে দেশটিতে প্রথম সড়ক নির্মাণ করা হয় ১৯৬১ সালে, তাদের সুখের কারণগুলোর খোঁজ পেতেই এ প্রতিবেদনের অবতারণা।
ভুটানে প্রতিবছর দারিদ্র্যের হার ক্রমেই কমছে। ২০০৭ সালে দেশটির ২৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। পরবর্তী পাঁচ বছরে এ সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনে তারা। আর ২০১৭ সালে গিয়ে এই হার দাঁড়ায় ৮.২ শতাংশ। চরম দরিদ্র প্রায় নেই বললেই চলে। তবে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য চরম। শহরবাসী দরিদ্রের সংখ্যা ১ শতাংশের কম হলেও গ্রামে এই হার ১১ শতাংশ।
ভুটানের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা দেশটির ৫৪ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে কৃষিকাজের মাধ্যমে। এ ছাড়া বনায়ন, পর্যটন ও জলবিদ্যুৎ দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা মূলত ভারতের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। আশির দশকে দেশটির জিডিপি ১৪ কোটি ডলার থাকলেও ২০১৭ সালে গিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫১ কোটি ডলারে।
ভুটানের তরুণদের জন্য বেকারত্ব একটি বড় সংকট। যদিও বেকারত্বের হার মাত্র ২.১ শতাংশ। তরুণদের (১৫-২৪ বছর বয়সী) ক্ষেত্রে এ হার ১৩.২ শতাংশ। পরিচ্ছন্ন খাবার পানি ভুটানের অন্যতম মৌলিক অধিকার। ৯৮ শতাংশ মানুষের জন্য এ অধিকার নিশ্চিত করেছে দেশটির সরকার। দেশটিতে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পয়সা দিতে হয় না। এটিও মৌলিক মানবাধিকারের অন্যতম। দেশটিতে মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর। যদিও ষাটের দশকে তা ছিল মাত্র ৩৭ বছর। ওই সময় পুরো ভুটানে মাত্র দুটি হাসপাতাল ছিল। বর্তমানে এর সংখ্যা ২৮। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক ১৫৬টি। সাধারণ ক্লিনিক রয়েছে ৬৫৪টি। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন নারীই প্রসবের সময় হাসপাতালে যায়। জীবিত নবজাতকের সংখ্যা ৯৩ শতাংশ।
ভুটানে সুখের সূচকে উতরে গেছে ৭৬ শতাংশ মানুষ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে আট হাজার পরিবারকে বেছে নিয়ে সুখের সূচক তৈরি করা হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানসিক অবস্থান ইত্যাদির ওপর প্রতিটি পরিবারকে তিন ঘণ্টাব্যাপী নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।
ভুটানে শিক্ষার হার কম হলেও তা দ্রুত বাড়ছে। ১৯৮৮ সালে তাদের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। তবে ২০১৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ ভুটানি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করেছে ৭০ শতাংশ ভুটানি। দেশটিতে শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়।
বনভূমি রক্ষায় ভুটান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভুটানই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা কার্বন উৎপাদন করে না। সাংবিধানিকভাবেই তারা দেশের মোট ভুখণ্ডের ৬০ শতাংশ বনভূমি রাখার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ফলে দেশটিতে যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হয়, এর চেয়ে শোষণের মাত্রা অনেক বেশি।
যদিও আধুনিক জীবনযাপনের চাপে তাদের পক্ষে কত দিন এ পরিস্থিতি রক্ষা করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশটির অর্থনীতি ও জনসংখ্যা দুই-ই বাড়ছে, যা পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের (ডাব্লিউডাব্লিউএফ) ভুটানের প্রতিনিধি দেচেন দরজি বলেন, ‘জলবিদ্যুৎ বা পর্যটনের মতো অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।’ বিদেশি প্রভাব একেবারে বন্ধ করা যাবে না। এটা ভুটানও বোঝে। এরপরও এর প্রভাব সীমিত রাখাতে ‘উচ্চমূল্য, কম প্রভাব’ নিশ্চিত করতে ভুটান বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে পর্যটকদের রোজ অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ ডলার খরচ করার বাধ্যবাধকতা অন্যতম।
বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের অবস্থান ২৭তম। এটা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতামত। মোট ১৬৮টি দেশ নিয়ে তারা এ তালিকা তৈরি করে। দেশটির বিচারব্যবস্থায় ঘুষ সংস্কৃতি প্রায় নেই বললেই চলে। নবীন গণতন্ত্রের এ দেশটির বাক্ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে সরকারের যেকোনো দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হতে পারে মিডিয়া।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুখ খাতে টেকসই উন্নয়ন ও বিনিয়োগ দেশটির ভবিষ্যেক উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে। সুখী ভুটানের মূল রহস্য মূলত এই ১০টি বিষয়। পাশাপাশি আরো অগ্রগতির সুযোগ ও উদ্যোগ—দুই-ই সরকারের তরফে রয়েছে। সূত্র : বর্জেন প্রজেক্ট।