ডিএমপি নিউজঃ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চিত্রনায়ক সালমান শাহ এর মৃত্যুর বিষয়ে রুজুকৃত অপমৃত্যু মামলাটির তদন্ত শেষ করেছে। তদন্তে চিত্রনায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয়েছে।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ বশির আহমেদ সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সালমান শাহ এর অপমৃত্যু মামলাটির তদন্ত সম্পর্কে জানান।
সালমান শাহ এর মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, সালমান শাহ এর পিতা মোঃ কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী অভিযোগ করেন গত ০৬/০৯/১৯৯৬ খ্রিঃ সকাল অনুমান ০৯.৩০ ঘটিকার সময় ১১/বি ইস্কাটন প্লাজা, নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকাস্থ বাসায় তার ছেলে সালমান শাহ এর সাথে দেখা করতে যান। সালমান শাহর বাসায় যাওয়ার পর সে ঘুমাচ্ছে শুনে তিনি সেখান থেকে ফিরে যান। অনুমান ১১.৩০ ঘটিকার সময় চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম সাহেব তাকে ফোন করে জানান সালমান শাহ এর যেন কি হয়েছে এবং তাকে দ্রুত সালমান শাহ এর বাসায় যেতে বলেন। তখন তিনি, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে দ্রুত সালমান শাহ এর বাসায় গিয়ে দেখেন সালমান শাহ তার শয়ন কক্ষে মরার মতো পড়ে রয়েছে। তখন তিনি উপস্থিত লোকজনদের সহায়তায় সালমান শাহকে বাসা থেকে বের করে দ্রুত নিকটস্থ ‘হলি ফ্যামিলি’ হাসপাতালে নিয়ে যান। যাওয়ার পথে তারা সালমান শাহ এর গলায় দড়ির দাগ এবং মুখমন্ডল ও হাত-পা নীলাভ বর্ণের দেখেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গেলে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার সালমান শাহকে মৃত ঘোষনা করেন।
সালমান শাহ এর পিতার লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে রমনা মডেল থানায় অত্র অপমৃত্যু মামলাটি রুজু হয়। এসআই/মোঃ মাহবুবুর রহমান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য প্রেরণ করেন। সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করেন। ডাঃ তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস মৃতদেহের ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন যে, ‘মৃত্যু ফাঁসের দরুণ ঝুলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যা মৃত্যুপূর্ব ও আত্মহত্যা জনিত (Suicidal In Nature)’। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার ডিবি-তে হস্তান্তর করা হয়।
ডিবি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ হুমায়ুন কবীর মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তকালে ১৫/০৯/১৯৯৬ খ্রিঃ সালমান শাহ এর মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় সুরতহাল ও ময়না তদন্ত করা হয়। তিনি আলামত জব্দ করেন। ডাঃ নার্গিস আরা চৌধুরী মৃতদেহের ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। মামলার তদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহ এর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আত্মহত্যা ব্যতিত কোন সন্দেহ না থাকায় অর্থাৎ সালমান শাহ এর মৃত্যুটি “আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু” মর্মে প্রমাণিত হওয়ায় গত ০৪/০২/১৯৯৭ খ্রিঃ “চূড়ান্ত রিপোর্ট” দাখিল করেন। বাদীর না-রাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত অপমৃত্যু মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ প্রদান করেন। ডিবি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ মজিবুর রহমান মামলাটির পুনঃতদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তকালে গত ১৯/০৭/১৯৯৭ খ্রিঃ মোঃ রেজভী আহমদ @ ফরহাদ (২০) সালমান শাহ এর পিতার বাসায় গিয়ে লেলিন পরিচয় দিলে তার বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্ট থানার মামলা নং-৩৭(০৭)৯৭ রুজু হয়। ঐ মামলায় তাকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। সে বিজ্ঞ আদালতে সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারা মতে জবানবন্দি প্রদান করে। এমতাবস্থায় বাদী বিজ্ঞ আদালতে অপমৃত্যু মামলাটি পেনাল কোড ৩০২/৩৪ ধারা মতে হত্যা মামলায় পরিগণিত করে তদন্তভার সিআইডিকে অর্পণের আবেদন করেন। অপমৃত্যু মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় উক্ত আবেদনটিসহ রেজভী আহমদ @ ফরহাদ এর ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দির বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিজ্ঞ আদালত আইজিপিকে নির্দেশ প্রদান করেন।
সিআইডি সিটি জোন ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ খালেক উজ-জামান পিপিএম অপমৃত্যু মামলাটিসহ হত্যা মামলার আবেদন ও মোঃ রেজভী আহমদ @ ফরহাদ এর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির বিষয়ে তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তকালে রেজভী আহমেদ @ ফরহাদকে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট এর তত্ত্বাবধানে জিজ্ঞাসাবাদে সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে সে কিছুই জানেন না এবং সে সালমানের একজন ভক্ত হিসাবে তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপর ও ছবি সংগ্রহের জন্য বাসায় গিয়েছিল জানায়। ক্যান্টনমেন্ট থানায় ও পরবর্তীতে আদালতে যে জবানবন্দি লেখা হয়েছে এটা তার নিজের কোন বক্তব্য নয়। তার তদন্তকালে অপমৃত্যু মামলার পুনঃতদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহ এর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আত্মহত্যা ব্যতিত অন্য কোন সন্দেহ বা অন্য কোন কারণ পাওয়া যায়নি। সালমান শাহ এর মৃত্যু পরিকল্পিত কোন হত্যাকান্ড নয়, রেজভী আহমদ @ ফরহাদ এর প্রদত্ত জবানবন্দি একান্তভাবেই সাজানো এবং সালমান শাহ এর মৃত্যুটি “আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু” মর্মে প্রমাণিত হওয়ায় তিনি গত ০২/১১/১৯৯৭ খ্রিঃ বিজ্ঞ আদালতে “চূড়ান্ত রিপোর্ট” দাখিল করেন।
বাদী না-রাজী আবেদন করেন এবং বিজ্ঞ আদালত উক্ত না-রাজী আবেদন না-মঞ্জুর করেন। বাদী গত ০৭/০৯/১৯৯৯ খ্রিঃ উক্ত না-মঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মেট্রো ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা নং-২৭৬/৯৯ দায়ের করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৯/০৭/১৯৯৯ খ্রিঃ অপমৃত্যু মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি ও সামগ্রিক বিষয়াদী পর্যালোচনায় অভিযোগকারীর আনিত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে প্রতিয়মান হওয়ায় বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জনাব ইমদাদুল হক গত ০৯/০৭/২০১৪ খ্রিঃ বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সালমান শাহ এর মা নিলুফার চৌধুরী @ নীলা চৌধুরীর বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে না-রাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি র্যাবকে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে বিজ্ঞ আদালতে ফৌজদারী রিভিশন মামলা নং-৩৫৮/২০১৫ দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিজ্ঞ আদালত র্যাব কর্তৃক তদন্তের আদেশ রহিত করণ করেন, নিম্ন আদালতকে বাদীর নারাজীর দরখাস্ত আইনানুযায়ী নিষ্পত্তির নির্দেশ প্রদান করেন এবং পূর্বের ইস্যুকৃত stay order এতদ্বারা vacate করেন। এমতাবস্থায় বিজ্ঞ আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ প্রদান করেন।
পরবর্তীতে গত ২০/১২/২০১৬ খ্রিঃ পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মোঃ সিরাজুল ইসলাম (বাবুল) মামলাটির তদন্তভার গ্রহন করে। মামলার তদন্তভার গ্রহণের পর পিবিআই প্রধান, ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার, বিপিএম (বার)-পিপিএম এর নির্দেশে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্তে সহায়তা করার জন্য পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ও পুলিশ পরিদর্শক মোঃ হুমায়ূন কবির মোল্লা এর সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয় এবং তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও সার্বিক দিক-নির্দেশনায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। পিবিআই কর্তৃক তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্ট ৪৪ (চুয়াল্লিশ) জন সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়াও ১০ (দশ) জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়।
পিবিআই কর্তৃক তদন্তে বিবেচ্য বিষয় সমূহঃ
১. ১ম ও ২য় সুরতহাল রিপোর্ট
২. ১ম ও ২য় ভিসারা রিপোর্ট
৩. কেমিক্যাল রিপোর্ট
৪. ১ম ও ২য় ময়না তদন্ত রিপোর্ট
৫. বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক মতামত
৬. হস্তলিপি বিশারদের মতামত
৭. ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিল্ডিংয়ে প্রবেশ এবং বাহির সংক্রান্তে বিশেষজ্ঞের মতামত
৮. রিজভী আহমেদ@ফরহাদ ও জরিনা বেগম এর অডিও রেকর্ড
৯. সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি
১০. ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রেকর্ডকৃত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬১ ধারায় জবানবন্দি
১১. জব্দকৃত আলামত পর্যালোচনা
১২. পূর্ববর্তী তদন্ত প্রতিবেদন সমূহ পর্যালোচনা
১৩. বিভিন্ন দালিলিক সাক্ষ্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, কাগজপত্র ও অন্যান্য সাক্ষ্য পর্যালোচনা
পিবিআই কর্তৃক তদন্তের ফলাফলঃ
১. সালমান শাহ খুন হননি
২. সালমান শাহ এর মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত