মহান স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি এ বিশ্ব চরাচর। নীল আকাশ, সবুজ-শ্যামল ভূমি, আঁকাবাঁকা নদী, সুউচ্চ পবর্তমালা, মনোরম ঝরনা ধারায় সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ ধরণী। যেন নিপুণ কারিগরের এক অপূর্ব কীর্তি। নিখুঁতভাবে সৃজন করেছেন হাজারো মাখলুকাত। আর সর্বোচ্চ সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে তৈরি করেছেন মানবজাতিকে।
মহান আল্লাহ তায়ালা অতি যত্ন করে তৈরি করলেন সর্বপ্রথম মহামানব হজরত আদম (আ.) কে। বাসস্থান হিসেবে দান করলেন চির শান্তির নীড় বিলাসবহুল জান্নাত। উন্মুক্ত করে দিলেন জান্নাতের অফুরন্ত সব নেয়ামত। এতকিছুর পরও হজরত আদম (আ.) এর মাঝে কি যেন অপূর্ণতা! সব কিছু থাকার পরও কি যেন নেই! বুকের গভীরে কিসের যেন হাহাকার!
মহান স্রষ্টা হজরত হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টির মাধ্যমে চিরদিনের জন্য দূরীভূত করলেন সে অপূর্ণতা। দান করলেন আশরাফুল মাখলুকাত মানবজাতির পূর্ণতা। নর ও নারী উভয়ের সমন্বয়ে মানবজাতির পরিচয়। অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী নারী জাতি ছিল অবহেলিত। বিশেষ করে আরবীয় জাহেলিয়াত যুগে নারী জাতি ছিল চরম নির্যাতিত। তাদের মানবীয় ন্যায্য অধিকার ছিল ভূলুণ্ঠিত। অর্থ-সম্পদকে পুরুষ নিজেদের মালিকানা স্বত্ব মনে করত। উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে নারীদের ছিল না কোনো নির্ধারিত অংশ। স্বামীর মৃত্যু বা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর ছিল না দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি। আরবীয় সমাজে নারী জন্মানোকে চরম অবমাননা, লাঞ্ছনা ও ঘৃণার কারণ মনে করা হতো।
নারী জন্মের প্রতি তাদের ঘৃণা এতই প্রবল ছিল যে, নিষ্ঠুর বাবা নির্দয়ভাবে নিজ মেয়েকে জীবন্ত প্রোথিত করতে দ্বিধাবোধ করত না। কিন্তু ইসলামই নারীর সম্মান, মর্যাদা ও প্রাপ্য অধিকারের ধারণা মানব মস্তিষ্কে জন্ম দিয়েছে। জাগরিত করেছে হারিয়ে যাওয়া নারীর ন্যায্য অধিকার।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে পুরুষদের ওপর, যেমন পুরুষদের আছে তাদের (নারীদের) ওপর।’ (সূরা বাকারা : ২২৮)। পবিত্র কোরআনে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘নেক আমল যেই করবে সে পুরুষ হোক বা নারী যদি সে ঈমানদার হয় তাহলে অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর আমি তাদের সৎ কর্মগুলোর বিনিময়ে উত্তম প্রতিদান দান করব।’ (সূরা নাহল : ৯৭)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে নারীদের নামে নামকরণ করে ‘সূরা নিসা’ নামক একটি সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যেখানে নারীদের অধিকারগুলো বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন কর। অতঃপর তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা এরূপ জিনিসকে অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।’ (সূরা নিসা : ১৯)।
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ, আর নারী যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ।’ (সূরা নিসা : ৩২)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘সে ব্যক্তি ভাগ্যবান যার প্রথম সন্তান হচ্ছে কন্যা।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘যার দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে এবং সে তাদের সঠিকভাবে লালন-পালন করে, দ্বীনি শিক্ষা দেয়, সৎ পাত্রস্থ করে তাহলে সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।’
ইসলাম বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতি গ্রহণকে করেছে বাধ্যতামূলক। নারীর অমতে জবরদস্তি করে বিয়ে নাজায়েজ ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কন্যাসন্তান ফাতেমাকে এত বেশি ভালোবাসতেন, কোথাও যাওয়ার আগে এবং ফিরে আসার পরে সর্বপ্রথম ফাতিমা (রা.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ইসলাম নারীর সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে দেনমোহর প্রদান পুরুষের ওপর বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ সংসারের সার্বিক ব্যয় বহন পুরুষেরই দায়িত্ব।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘তোমরা নারীদের সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর প্রদান করো, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয় তাহলে তোমরা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে গ্রহণ করো।’ (সূরা নিসা : ৪)।
পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে বানিয়েছে বিজ্ঞাপন ও ব্যবসার পণ্য। আর ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। সুনিশ্চিত করেছে তার প্রাপ্য অধিকার। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা।’ (বোখারি : ৫৫৪৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’
ইসলাম পর্দার বিধানের মাধ্যমে নারীকে আবদ্ধ করেনি। বরং নারীর মান, ইজ্জত ও জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেছে। কোনো নারীর মাঝে আত্মিক ও বাহ্যিক পর্দা বিদ্যমান থাকলে কেউ তার মর্যাদা বিনষ্ট করতে পারে না।
ইসলাম উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের অংশের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করেছে যে, নারীর অংশ দ্বারা পুরুষের অংশ নির্ধারণ করেছে। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘দুই মেয়ের অংশ পরিমাণ এক ছেলের অংশ।’ (সূরা নিসা : ১১)। এমন বলেননি, এক ছেলের অংশের পরিমাণ দুই মেয়ের অংশ।’ ইসলাম বাবার অংশে মেয়ে সন্তানের তুলনায় ছেলে সন্তানকে দ্বিগুণ দেওয়ার অনেক যুক্তি ও কারণ রয়েছে। ইসলাম পুরুষের ওপর সংসারের সার্বিক ব্যয় বহনের দায়িত্ব আরোপ করেছে। নারীকে দেনমোহর প্রদান, মেয়ে বা বোনদের বিয়ে-শাদির সব ব্যয় পুরুষকেই বহন করতে হয়। বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, বাসস্থান প্রদান এবং আত্মীয়স্বজনের মেহমানদারির গুরু দায়িত্ব পুরুষের ওপরই বর্তায়। এসব ক্ষেত্রে নারীর কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেই। বরং ইসলাম নারীকে স্বামী প্রদত্ত মোহরানা এবং স্বামীর সম্পদে তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলাম নারীদের সুশিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করেছে। উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশা (রা.) এত বড় জ্ঞানী ও শিক্ষিতা ছিলেন, বিজ্ঞ সাহাবিরা কোনো শরয়ি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে তার থেকে সমাধান জেনে নিতেন।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা নর-নারী উভয়কেই সৃষ্টি করেছেন। পার্থিব জীবনের বিশেষ প্রয়োজনে কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের অধিকার বেশি দিয়েছেন। আবার কোনো ক্ষেত্রে নারীর অধিকার বেশি দিয়েছেন। তবে মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা, সমাজের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হোক নারীর মর্যাদা। মায়ের জাতি ফিরে পাক তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান। সূত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ।