কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্যান পরিদর্শন করছেনবাকৃবি জার্মপ্লাজম সেন্টার । বাহারি স্বাদের ও রঙের ফল সব বয়সী মানুষের পছন্দ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পুষ্টিকর ফল খুবই উপকারী। বিশেষজ্ঞদের মতে একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশ, শস্যের পাশাপাশি ফলমূলেও বেশ প্রসিদ্ধ। ফলমূলে দেশকে আরো সমৃদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) জার্মপ্লাজম সেন্টার। ১৯৯১ সালে মাত্র এক একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ’ নামের একটি প্রকল্প।
পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘ফলগাছ উন্নয়ন প্রকল্প’। এটিই এখন ৩২ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বে দ্বিতীয় ‘জার্মপ্লাজম সেন্টার’ হিসেবে। সেন্টারটিতে রয়েছে অসংখ্য বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতির দেশীয় ফল আর ওষুধি গাছের সমাহার।
জ্যৈষ্ঠ মাসে এই ফলদ বৃক্ষের জাদুঘরের বামন গাছগুলোতে ঝুলে থাকে অসংখ্য কাঁচা-পাকা ফল, যা দেখে জিহ্বায় পানি এসে যায়। কণ্টকাকীর্ণ অমসৃণ কাণ্ড, আগুন রাঙা চোখ এবং ড্রাগনের অবয়বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। গায়ে খাঁচ কাটা, ক্যাকটাস পরিবারের একটি ফল ড্রাগন! শুনেই মনে হচ্ছে আরব্য রূপকথার সেই দানবের কথা। না, এবার সেটি দানব হিসেবে নয়, খ্যাত ফল হিসেবে।
শুধু ড্রাগন নয়, এমন হাজার প্রজাতির আকর্ষণীয় বিরল দেশী-বিদেশী ফলের গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে খোলা আকাশের নিচে এক ফালি জমিন কামড়ে। কোনোটি মওসুমি, কোনোটি দোফলা, কোনোটি ত্রিফলা আবার কোনোটি বারমাসী। কোনোটি দেশী, কোনোটি বিদেশী আবার কোনোটি উদ্ভাবিত। সময়ের সাথে ফল ঝরে পড়ে আবার নতুন ফলে ভরে যায় গাছ। তাই এটি একেবারেই জীবন্ত। প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে দেশী-বিদেশী অনেক গবেষক ও দর্শনার্থী আসেন এ ফলদ বৃক্ষের জাদুঘর দেখতে। শুধু দেখতেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চারা সংগ্রহ করতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। দেশের বাইরেও এর প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
১৯৯১ সাল থেকে মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে মোট ৭৫টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে এখানে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২১টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৩টি, জাম্বুরার ৫টি, কামরাঙ্গা ৩টি, বাউ-কুলের ৩টি, লিচু ৩টি, জলপাই, আমলকী, ডুমুর, মালটা, অরবরই ও কাজুবাদামের ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি, বাউ রসুন ৩টি, বাউ গাজর ২টি, বাউ মিষ্টিকুমড়া ২টি জাত, বাউ মাল্টা-১টি, বাউ স্ট্রবেরি-টি১ এবং বাউ ডুমুর-১টি। এ ছাড়া বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল), বাউ ড্রাগন ফল-৩, বাউ লঙ্গা-১ (বোগর), বাউ তেঁতুল-১ (মিষ্টি), বাউ তেঁতুল-২ (টক), বাউ কদবেল-১ (বনলতা), বাউ পেয়ারা-৭ (বীজশূন্য গোল), বাউ পেয়ারা-৮ (বীজশূন্য ডিম্বাকার) উল্লেখযোগ্য।
এ জাদুঘরে রয়েছে ১৮১ প্রজাতির প্রায় ১০,২৭৩ জাতের মাতৃগাছ, যার মধ্যে ১১৯৫টি দেশী-বিদেশী বিরল জাতের। এসব দেশী-বিদেশী বিরল গাছের মধ্যে রয়েছে ২২০ রকমের আম, ৫৭ রকমের পেয়ারা, ২৩ রকমের লিচু, ৪৭ রকমের লেবু, ৯৪ রকমের কাঁঠাল, ৬৭ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় অপ্রধান ফল, ৬৮ প্রজাতির ফলদ ওষুধি গাছ, ২৭ প্রজাতির ভেষজ গাছ ও ৫৮ প্রজাতির বিদেশী ফল। আর এসবই সেন্টারটিকে পরিণত করেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ফলদ বৃক্ষের বিরল সংগ্রহশালায়।
ফল বলতে আমরা সাধারণত আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস, আপেল, আঙ্গুর, আর লেবু ও কমলা লেবুকে বুঝি। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে জানা-অজানা অনেক ফল। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার মধ্যে প্রায় ৭০টি ফল অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি। এসব ফল নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় দেশ থেকে বিলুপ্তির পক্ষে।
আশার বিষয় হচ্ছে, বিলুপ্ত প্রায় এ ফলগুলো বন, জঙ্গল, পাহাড়, বসতভিটাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এ জার্মপ্লাজম সেন্টার সন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও রণাবেণ করছে এবং এর ওপর নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন বিদেশী ফল বা ফলের গাছ যেমনÑ প্যাসন ফল, জাবাটিকাবা, শানতোল, রাম্বুটান, লংগান, ম্যাঙ্গোস্টিন, সিডলেস লিচু, ডুরিয়ান, এভোকেডো ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে এ দেশে নতুন জাত হিসেবে মুক্তি দিতে। বর্তমানে এখানে ৪৯টি দেশের প্রায় ৫৮টি ফল ও ফলগাছের ওপর গবেষণা চলছে।
এ সেন্টারে গবেষণাকার্যক্রম পরিচালিত হয় মূলত পিএইচডি ও মাস্টার্স (এমএস) পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্নপর্যায়ের ছাত্রছাত্রী এ সেন্টারে গবেষণাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক হিসেবে আছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এম এ রহিম এবং তার গবেষণা সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কৃষিবিদ ড. মো: শামছুল আলম মিঠু। এ পর্যন্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ এ সেন্টারটি জাতীয়ভাবে সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছে, যার মধ্যে ২০০৩ সালে বৃরোপণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম পুরস্কার। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংবর্ধনার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছে ৩০ বারেরও বেশি।
এ ছাড়া জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. এম এ রহিম পেয়েছেন সুদূর আমেরিকা থেকে নরমেন আরনক বোরলক পুরস্কার। সম্প্রতি কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জার্মপ্লাজম সেন্টার লাভ করেছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪১৯।
অধ্যাপক ড. এম এ রহিম বলেন, বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান ও ুদ্র আয়তনের তীব্র জনবহুল দেশ। এই দেশের ১৬ কোটি মানুষের দৈনন্দিন ফলের পুষ্টি ঘাটতি মেটানো এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার ুদ্র প্রয়াস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এ জার্মপ্লাজম সেন্টার।