সাতক্ষীরা জেলার নলতা, মাঘুরালী, মধ্য নলতা, ইন্দ্রনগর ও সোনাটিকারী গ্রামের নারী-পুরুষ এখন ব্যস্ত গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করে এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এখানে উৎপাদিত হচ্ছে উন্নতমানের সার্জিক্যাল গজ-ব্যান্ডেজ। এ কাজ করে উপজেলার প্রায় আট হাজার পরিবার জীবিকা নির্বাহ করেন। আর এসব উৎপাদিত গজ-ব্যান্ডেজ যাচ্ছে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
নলতা ইউনিয়নের নলতা শরীফ এলাকায় ঢুকতেই কানে শব্দ আসে খট খট খট…। এক বাড়ি নয়, দুই বাড়ি নয়, পাশাপাশি প্রায় সব বাড়িতেই একই শব্দ। প্রতিটি বাড়িতেই চলছে আধুনিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত পাওয়ার লুম। পাশাপাশি দুই-তিনটা পাওয়ার লুম পরিচালনা করছেন একেকজন আবার কেউ বা বাধছেন সুতো।
২০ বছর আগেও এখানকার কারিগররা হস্ত পরিচালিত তাঁতে বুনতেন শাড়ি, গামছা ও লুঙ্গি। কিন্তু এখন সবাই বোনেন গজ-ব্যান্ডেজ। আর এর উপরেই নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা।
দীর্ঘ ২৫/২৬ বছর ধরে নিজের বাড়িতেই আপন মনে তাঁত বুনছেন মিজান কারিগর। পারিবারিকভাবে তাঁতের সঙ্গে তার পরিচয়। বাপ-দাদা সবাই তাঁত বুনতেন। তখন শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরি হতো। তখন পুরো জেলায় নলতার গামছার নাম ছিল। তিনিও কাজ শিখে প্রায় ১২ বছর শাড়ি, লুঙ্গি আর গামছা তৈরি করেন। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। এলাকায় সবাই চলে আসে গজ-ব্যান্ডেজ।
শাড়ি, লুঙ্গি বা গামছা তৈরি ছাড়ার কারণ হিসাবে ফয়সাল কারিগর বলেন, এখন আর সেই সুতো, রং আসে না। রং করলে স্থায়ী হয় না। তাই সবাই গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন মহাজনেরা নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে আমাদের কাছে দেয়। আমরা সেই সুতা দিয়ে শুধু গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করি এবং সে অনুযায়ী মজুরি পাই।
মধ্য নলতা গ্রামের তাঁতি রফিকুল ইসলাম বলেন, সুতা মহাজন দেয় আর আমরা শুধু কাজ করি। মেশিন আমাদের। ৩৬ হাত গজ-ব্যান্ডেজে এক একটি রোল তৈরি হয়। এক রোল তৈরি করলে ২০ টাকা পায়। একা তিনটা মেশিন চালানো যায়। প্রতিটি মেশিনে দিনে ছয়-সাতটি রোল গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করা যায়।
তাঁতি সুশীল দাস বলেন, এখন তো আর হাতের তাঁত নেই। এক একটা পাওয়ার লুম মেশিনের ২৪ থেকে ২৬ হাজার টাকা দাম পড়ে। নিজস্ব তিনটা মেশিনে আমি প্রতিদিন কাজ করে গড়ে চারশ টাকা পাই।
তিনি আরো বলেন, আগে আয় বেশি হতো আর এখন ৩৬ হাত লম্বা গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করে মাত্র ২০ টাকা পায়। কিন্তু তাঁতে উৎপাদিত শাড়ির দাম বেশি ছিল। যদিও উৎপাদন বেশি, কষ্ট কম। মেশিন অন করে চালিয়ে রেখে মাঝে মধ্যে একটু দেখাশুনা করলেই হয়।
মাঘুরালী গ্রামের তাঁতি লতিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মেশিনে সুতা বাধছিলেন। সুতা বাধার জন্য তিনি পান একশ টাকা। এই কাজে কষ্ট কম বলে লতিফার মতো কয়েকশ গৃহিণীসহ পরিবারের সবাই মিলে পাওয়ার লুম মেশিনে গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করে।
ইয়াসিন নামের অপর এক তাঁতি বলেন, এলাকার বেকার ছেলে-মেয়েরা ডিজিটাল এই পাওয়ার লুম মেশিনে কাজ করে এবং এতে আয়ও ভালো হয়। তবে এই আধুনিক পাওয়ার লুম মেশিনে যে কোনো সমস্যা নেই তা কিন্তু নয়। একদিন বিদ্যুৎ না থাকলে বন্ধ হয়ে যায় নলতা এলাকার গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির কর্মযজ্ঞ আর রয়েছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের থাবাও।
তাঁতশিল্পের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহকারী নলতার ওমর আলী, মাসুল, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, গোপাল, দীপঙ্কর ও নাসিমা খাতুন বলেন, গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির কাজে আসার পর থেকে এখন আর তাদের সংসারে অভাব নেই।
এলাকায় তাঁত ব্যবসার মহাজন বলে পরিচিত শ্যামল কুমার পাল জানান, তার কারখানায় ২৫টি পাওয়ারলুম মেশিন রয়েছে। এখানে ৮-৯ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে থাকে। নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে তারা গজ-ব্যান্ডেজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যান্ডেজগুলো ধুয়ে জীবানুমুক্ত করে পাঠানো হয় ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে। এসব কাজে পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে আমরা ব্যবসা ভালোভাবে চালাতে পারি না। সরকারের তৎপরতায় তফসিল ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ঋণ দিলে আমাদের গজ-ব্যান্ডেজ ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যেমন সহজ হবে, তেমনি ক্ষুদ্র কারিগররা বেশি মজুরি পাবে।