ডিএমপি নিউজঃ প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সৃষ্টিকর্তার উপর অফুরন্ত বিশ্বাস থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে মানুষ। তেমনি বেশ আলোচিত একটি নাম তোফা-তহুরা। একটি দেহের দুইটি জীবন। কে জানতো একদিন এই একটি দেহ থেকে তারা বাবা-মার কোলো ফিরে যাবে দুইটি ভিন্ন দেহ নিয়ে। আজ তারা সুস্থ আছে। বেঁচে আছে নিজের একটি একক নাম পরিচয় নিয়ে।
এইতো বছর খানেক আগে অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার জিনিয়া গ্রামের দরিদ্র রাজু ও সাহিদা দম্পতির কোল জুড়ে আসে দুইটি কন্যা শিশু। কিন্তু শিশু দুইটি স্বাভাবিক না হয়ে দুইটি কোমড়ে জোড়া লাগানো ছিল যা ডাক্তারি ভাষায় “পাইগোপ্যাগাস” নামের একটি জন্মগত ত্রুটি।
এমন শিশু জন্মের পর শিশু দুটিকে দেখতে ছুটে আসে অনেকে। জন্মের পর শিশু দুটি বাড়িতেই ছিল। কোমড় জোড়া থাকায় শিশুর পেট ফুলে উঠছিল ও বমি করছিল এবং তারা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন খবর গাইবান্ধা জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ নির্মেলেন্দু চৌধুরীর কাছে আসলে তিনি ঢাকায় স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলে মহাপরিচালক শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
৭ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে বিশেষ ব্যবস্থায় গাইবান্ধা থেকে শিশুদের নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শিশু সার্জারি বিভাগের চতুর্থ ইউনিট প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলামের অধীনে জরুরী ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ১২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সেপ্টিসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে এনে পেটে অস্থায়ী মলদ্বার স্থাপনে অস্ত্রোপচার করা হবে। এর মধ্যে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জোড়া শিশুদের দেখতে হাসপাতালে আসেন এবং তাদের চিকিৎসাভার রাষ্ট্র বহন করবে বলে ঘোষণা দেন।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পেটে পায়ুপথ তৈরি করা হয় গত বছরের ২০ অক্টোবরে। তারপর মা সাহিদা দুইজনের নাম রাখেন তোফা-তহুরা। বিরল জোড়া লাগানো শিশুদের প্রথম অস্ত্রোপচার চিকিৎসকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিরলস চেষ্টায় সফলভাবে পায়ুপথের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। অস্ত্রোপচারের পর পুনরায় মেডিকেল বোর্ড এমআরআই করার নির্দেশ দেয়। এমআরআই এর রিপোর্টসহ পুনরায় মেডিকেল বোর্ড বসে।
তোফা-তহুরার ওজন কম থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ছয় মাস পর অস্ত্রোপচার করে তাদের আলাদা করা হবে। এই ছয় মাসে তারা একমাস পর পর চেকআপে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসবে এবং এর মাঝে কোন অসুবিধা হলে এর আগেও আসতে পারবে।
দেখতে দেখতে পার হল ছয় মাস। তোফা-তহুরাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে তার বাবা-মাকে বলা হলো ।
১ আগস্ট ২০১৭ ইতিহাস সৃষ্টিকরে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মেডিকেল সাইন্সের সামর্থ্য তুলে ধরার একটা দিন । তোফা-তহুরার অস্ত্রোপচারের পূর্বে তাদের ক্লিনিক্যাল প্যাথোলজি, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, নিউক্লিয়ার মেডিসিনসহ প্রত্যেক বিভাগের সাথে শিশু সার্জারি বিভাগের সমন্বয়ে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে দুই বোনকে আলাদা করেন চিকিৎসকরা।
তোফা-তহুরা থেকে তারা হয়ে গেল তোফা ও তহুরা। সফলভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অসাধ্যকে সাধ্য করে দেখিয়েছেন আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
আজ তাদের বাড়ি ফেরার দিন। এসেছিল একসাথে একটি দেহের দুইটি মানুষ হয়ে । আর ফিরে যাচ্ছে দুইটি মানুষ নিজ নিজ দেহ নিয়ে। অস্ত্রোচারের মাধ্যমে আলাদা জীবন পাওয়া শিশু তোফা ও তহুরাকে কোলে নিয়ে তাদের বাবা-মা সংবাদ সম্মেলনের এসেছেন।
রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনের আসেন তোফার বাবা মো.রাজু আর তহুরা মা সাহিদা বেগম। তাদের দুজনের কোলে ছিল তোফা ও তহুরা। দুপুর ১টার দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আসেন ওই কক্ষে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাহনুর ইসলাম বলেন, তোফা ও তহুরা ভাল আছে। তিনি তোফা ও তহুরার চিকিৎসার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন,তাদের পুর্নবাসনের প্রয়োজন।
তাই তাদের বাবা মার নামে ডাচ বাংলা ব্যাংকে ইমামগঞ্জ শাখায় যৌথ একাউন্ট খোলা হয়েছে। একাউন্ট নম্বর হলো-১৩৯১৫১৭৩৭৪০, এই নম্বরে আগ্রহী দাতাগণকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান সাহনুর।
তিনি বলেন, তাদের আরও দুটি অপারেশন করা হবে। তবে দিন তারিখ অন্যান্য সিনিয়ন চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হবে।
তোফা ও তহুরা স্বাভাবিক অন্য শিশুদের মত খাওয়া -দাওয়া করছে এবং গতকাল (শনিবার) তোফা বসতে শিখেছে। তাদের আজই একটি অ্যাম্বোলেন্সে করে গ্রামের বাড়ি পাঠানো হবে বলে সাহনুর ইসলাম জানান।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে দুই শিশুর বাবা রাজু মিয়ার একটি চাকরির আশ্বাস দেন।
কৃষক রাজুর সন্তান তোফা ও তহুরার চিকিৎসা অর্থের জন্য থেমে থাকেনি, মেশিন নষ্ট বা যন্ত্রপাতি নেই সেজন্যেও কালক্ষেপন ঘটেনি। শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে মূল শক্তি দক্ষতা ও টিমওয়ার্ক। তোফা ও তহুরা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা সেবার একটি উজ্জ্বল সাফল্য। তোফা ও তহুরার ঘটনা প্রমাণ করলো বাংলাদেশী চিকিৎসকদের উপর আস্থা রাখলে বিশ্বমানের সেবা বাংলাদেশেই দেয়া সম্ভব। সুস্থ থাকো তোফা, সুস্থ থাকো তহুরা। বেঁচে থাকো আপন ভূবনে নিজের মত করে।