বিশ্বজুড়ে অন্য খেলার মতো ক্রিকেটও বেশ জনপ্রিয়। আর উপমহাদেশের তো প্রধান খেলা বলা চলে ক্রিকেট। উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি উঠতি তরুণই বোধহয় বর্তমানে স্বপ্ন দেখে ক্রিকেটার হওয়ার। নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। তবে ক্রিকেটে এমন উদাহরণও আছে যে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় শুধু একদেশ না, দুই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাও আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
আসুন দেখে নেয়া যাক এমন কয়েকজন ক্রিকেটার যাঁরা দুই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন-
ইফতিখার আলী খান পতৌদি : ইফতিখার আলী খান পতৌদি যিনি সিনিয়র পতৌদি নবাব হিসেবে বেশি পরিচিত।তিনি একমাত্র খেলোয়াড় যে ভারত ও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে সিডনিতে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে তার অভিষেক হয়।
অ্যাশেজের ওই অভিষেক টেস্ট ম্যাচে তিনি ১০২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরো দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন। পরে ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে তিন টেস্ট সিরিজের ইংল্যান্ড সফরের সময় ভারতের নেতৃত্ব দেন।তিনি ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদির বাবা। আর তার নাতি-নাতনি দুইজন বলিউড স্টার সাইফ আলী খান ও সোহা আলী খান।
আব্দুল হাফিজ কারদার : আব্দুল হাফিজ কারদারকে পাকিস্তান ক্রিকেটের জনক পর্যায়ের একজন বিবেচনা করা হয়। তার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে।১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে ভারতের হয়ে তার অভিষেক হয়। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
তিনি প্রথম পাকিস্তানি টেস্ট অধিনায়ক যার নেতৃত্বে ১৯৫২-৫৩ মৌসুমে ভারত সফর করে পাকিস্তান। এছাড়া তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং সুইজারল্যান্ডে পাকিস্তানের অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পালন করেন।
আমির এলাহী : আমির এলাহী ছিলেন লেগ ব্রেক গুগলি বোলার।১৯০৮ সালে তিনি লাহোরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারতের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন।
১৯৫২-৫৩ মৌসুমে পাকিস্তান টেস্ট স্ট্যাটাস পেলে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। পরে তিনি পাকিস্তানের হয়ে পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন। তিনিই প্রথম খেলোয়াড় যিনি প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের জন্য ১ নম্বর ক্যাপ নিয়ে খেলেন।
গুল মোহাম্মেদ : গুল মোহাম্মেদ ছিলেন বাঁহাতি আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। ১৯৪৬ সালে ভারতের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ম্যাচে তার অভিষক হয়। এ ছাড়া ১৮৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফর ও ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সফরেও তিনি ভারত দলের অংশ ছিলেন।
পরে ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন। তারপর তিনি একটিমাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলেন পাকিস্তানের হয়ে। তবে সেই ম্যাচটি তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন। কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই টেস্টে তার ব্যাট থেকেই জয়সূচক রানটি আসে।
কেপলার ওয়েসেলস : কেপলার ওয়েসেলস ছিলেন বাঁহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান। তার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু ১৯৮২ সালে ব্রিজবেনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট অভিষেক হয় তার। প্রথম ইনিংসেই তিনি ১৬২ রানের অনবদ্য এক স্কোর গড়েন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আরো ২৩ টি ম্যাচ খেলেন।
পরে ১৯৮৫ সালে তিনি অবসর ঘোষণা করেন। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিল। তার অবসরের ছয় বছর পর ১৯৯১ সালে আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর থেকে ২২ বছরব্যাপী লম্বা সময়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এ সময় ওয়েসেলসকে তার নিজ মাতৃভূমির জন্য খেলতে অনুরোধ করা হয়। পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা দলে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিনায়কত্ব পান। তিনি তিন বছর দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিনায়ক ছিলেন। পরে ১৯৯৪ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল)দল চেন্নাই সুপার কিংসের কোচও হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে সুপরিচিত।
গেরেট জোন্স : গেরেট জোন্স পাপুয়া নিউগিনিতে জন্মগ্রহণ করেন। জোন্স যখন শিশু তখন তার বাবা মা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। জোন্স অস্ট্রেলিয়ায় জুনিয়র লেভেলে ক্রিকেট খেলেন। পরে ইংল্যান্ড চলে যান। আর ২০০৪ সালে উইকেটকিপার কাম ব্যাটসম্যান হিসেবে ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার।
২০০৫ সালে অ্যাশেজ জয়ে ইংল্যান্ড দলের অংশ ছিলেন জোন্স। কিন্তু ২০০৬-৭ মৌসুমে অ্যাশেজে তিনি খুব খারাপ খেলেন। এই কারণে ইংল্যান্ড দল থেকে তিনি বাদ পড়েন। পরে তিনি পাপুয়া নিউগিনির হয়ে আইসিসি বিশ্ব টি-টোয়েন্টির কোয়ালিফায়িং ম্যাচ খেলেন। আর ২০১৪ সালে হং কংয়ের বিপক্ষে পাপুয়া নিউগিনির হয়ে তার ওয়ানডেতে অভিষেক হয়। তিনি একটি বাজে বিশ্ব রেকর্ডের মালিকও। টেস্টে ৪৬ ইনিংসে ডাক মেরে তিনি এই রেকর্ডের মালিক হয়েছেন।
এড জয়েস : জয়েস বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ও ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। তিনি আয়ারল্যান্ডের হয়ে আইসিসি ট্রফি খেলেন। কিন্তু বসবাসের কারণে পরে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেন।
২০০৬-৭ মৌসুমে ইংল্যান্ডের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ত্রিদেশীয় সিরিজে তার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। কিন্তু ২০১০ সালে তিনি ইংল্যান্ড দল থেকে বাদ পড়েন। পরে তিনি আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন। এই পর্যন্ত তিনি আয়ারল্যান্ডের হয়ে ৪৬ টি ওয়ানডে ও ১৬টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন।
লুক রঞ্চি : লুক রঞ্চি উইকেট কিপার কাম ব্যাটসম্যান। তার জন্ম নিউজিল্যান্ডে। তবে তিনি যখন খুব ছোট তখন তার বাবা মা অস্ট্রেলিয়ায পাড়ি জমান। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তার টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডেতে অভিষেক হয়। ২০০৮ সালের জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে তার অভিষেক হয়।
অসিদের নিয়মিত উইকেট কিপার ব্রাড হাডিন ইনজুরিতে পড়ায় তিনি এই সুযোগ পান। কিন্তু হাডিন যখন সুস্থ হয়ে দলে ফিরে আসেন তখন রঞ্চিকে দলের সাইড বেঞ্চে বসে বসে খেলা দেখতে হয়। কিছুদিন এভাবে কাটার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিউজিল্যান্ড ফিরে যাবেন। পরে তিনি নিউজিল্যান্ড চলে যান। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ড সফরে তিনি কিউই দলে ডাক পান। সেই থেকে তিনি নিউজিল্যান্ড দলে নিয়মিত খেলছেন।
ইয়ান মরগান : ইয়ান মরগান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ২০০৬ সালের আগস্টে আয়াল্যান্ডের হয়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে তিনি বিরল এক রেকর্ডও করেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি অভিষেক ম্যাচে ৯৯ রান করে আউট হন।
২০০৭ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে তিনি আয়ারল্যান্ড দলে অন্তর্ভুক্ত হন এবং মোট ২৩টি ম্যাচ খেলেন আয়ারল্যান্ডের হয়ে। পরে ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলবেন এই ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি ইংল্যান্ড চলে যান। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে তার অভিষেক হয়। তারপর থেকে তিনি দলের নিয়মিত সদস্য। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ড দলের টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের অধিনায়ক।
ডার্ক ন্যানেস : ডার্ক ন্যানেস বাঁহাতি ফাস্ট বোলার। তার অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নেদারল্যান্ডের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে তার অভিষেক হয়। এর মাত্র দুই মাস পরে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্যারিয়ারের একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেন।
তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ও চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেছেন। বর্তমানে তিনি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন।