উত্তর কোরিয়া রোববার যে পরমাণু বোমার পরীক্ষা করেছে সেটি হাইড্রোজেন বোমা । অর্থাৎ যেটি ধ্বংসক্ষমতার বিচারে সাধারণ পরমাণু বোমার চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিধর। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা একযোগে স্বীকার করছেন, এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া যতগুলো পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে, এটি ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।
মাটির নিচে দশ কিমি. গভীরে এ বিস্ফোরণের পর রিখটারস্কেলে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যা পার্শ্ববর্তী চীনের বেশ কিছু এলাকাতেও ভূকম্পনের সৃষ্টি করে। বিস্ফোরণের পর ভূকম্পনের মাত্রা বিবেচনা করে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষা করা বোমাটির শক্তি ছিল ১০০ কিলোটনের মতো। অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে জাপানের নাগাসাকি শহরে ফ্যাট ম্যান নামে আমেরিকার যে পরমাণু বোমা তাৎক্ষণিক ৭০ হাজার মানুষের জীবন নিয়েছিল, উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ বোমটির শক্তি তার চেয়ে পাঁচ গুণ (অনেকে বলছেন আট গুণ) বেশি।
আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ভিপিন নারাং ব্লুমবার্গ সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, বোমাটি হাইড্রোজেন বোমা হোক আর না হোক, এটি দিয়ে আমেরিকার যে কোনো বড় একটি শহর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব।
উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষা করা বোমাটি যদি হাইড্রোজেন বোমা হয়ও, তার পরেও এখন পর্যন্ত বিশ্বে ভয়াবহ যেসব পরমাণু বোমার পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় এটির ক্ষমতা নগণ্যই বলা যায়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ হয়েছিল ১৯৬১ সালে যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘জার বোমবা’ বা ‘বোমার রাজা’ নামে একটি পরমাণু বোমা পরীক্ষা করে। ওই হাইড্রোজেন বোমার শক্তি ছিল ৫০ হাজার কিলোটন। আর্কটিক অঞ্চলে নোভায়া জেমলিয়া নামে দ্বীপপুঞ্জের যে জায়গায় ওই দানবীয় বোমাটি পরীক্ষা করা হয়েছিল, তার ৩৫ মাইলের মধ্যে সব ভবন, স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এমনকি শত শত কিলোমিটার দূরেও ভবনে ক্ষতি হয়েছিল। ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মতো অনেক দূরের দেশগুলোতেও বহু বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে পড়েছিল।
তবে বিশ্বের প্রথমবারের মতো হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫২ সালে, প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপে। সেটির শক্তি ছিল ১০ হাজার কিলোটন। ৫০ কিমি. দূরে একটি জাহাজে বসে সেই পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মার্কিন একজন পদার্থবিজ্ঞানী হ্যারল্ড অ্যাগনিউ। তিনি পরে বলেছিলেন, অত দূরে বসে যে তাপ সেদিন বোধ করেছিলাম তা জীবনেও ভুলব না। ক্রমাগত তাপ আসছিল। ভীতিকর এক অভিজ্ঞতা ছিল সেটি। পরীক্ষার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ৫০ কিমি. উপরে উঠে গিয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল ১০০ কিমি. পর্যন্ত। সেই বিস্ফোরণের কম্পন সারা বিশ্বের তিনবার অনুভূত হয়েছিল। সেটির ওজন ছিল ২৭ টন। বোমাটি প্যারাসুটের সাহায্যে ছোড়া হয়। তবে ক্রুরা ফিরতে পারবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, কিন্তু ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু পরীক্ষা ছিল ১৯৫৪ সালে ওই মার্শাল দ্বীপেরই বিকিনি অ্যাটল এলাকায়। শক্তি ছিল ১৫ হাজার কিলোটন। সেটি পরীক্ষার পর ১১ হাজার কিমি. পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছিল। শত শত মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, যাদের অনেকেই আর কখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০০ পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এর অর্ধেকই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে যুদ্ধে এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রই পরমাণু বোমা ব্যবহার করেছে। হাইড্রোজেনের বোমারও প্রথম বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫২ সালে।
আরও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া : উত্তর কোরিয়া আরও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা এমন আভাস পাচ্ছে যে, উত্তর কোরিয়া শিগগিরই আরও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে যাচ্ছে এবং সম্ভবত সেগুলো হবে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)।
পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যে ‘থাড’ মিসাইল ডিফেন্স বসিয়েছে তা এখন আরও শক্তিশালী করা হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, তাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘাঁটি আছে তাতে আরও চারটি রকেট লাঞ্চার বসানো হবে, যাতে উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি মোকাবিলা করা যায়।
চলতি সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া একটি হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করেছে। মাটির নিচে ঘটানো এ বিস্ফোরণের ফলে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তা চীন থেকেও অনুভব করা গেছে। ১০০ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন ওই বোমাটি ছিল উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষা করা এ পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা। উত্তর কোরিয়া বলেছে, এই বোমাটি এমন আকারের, যা একটি ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায় বসিয়ে নিক্ষেপ করা সম্ভব। এর পর দক্ষিণ কোরিয়া গোলাবারুদ ব্যবহার করে এক সামরিক মহড়া চালায়।