আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ, জীবিকার বেলায় আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা, সবসময় আশাবাদী থাকা হৃদয়ের প্রফুল্লতার জন্য খুব জরুরি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও দোয়া করাই সুখ লাভের শ্রেষ্ঠ পন্থা। হৃদয়ের প্রশান্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর জিকিরের প্রভাব বিরাট।
পবিত্র মসজিদ মসজিদে নববির ইমাম শায়খ ড. আবদুল মুহসিন আল-কাসেম ২৪ সফর ১৪৪০ হিজরি মদিনা শরিফের জুমার খুতবায় মানব জাতির পবিত্র জীবন লাভের উপায় বা পন্থা বলে দিয়েছেন। মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ।
দুনিয়া হচ্ছে মুমিনদের জন্য পরীক্ষা ও যাচাইয়ের স্থান। ক্লেদ ও ক্লান্তি তার মজ্জাগত প্রকৃতি। মানুষ সেখানে বিভিন্ন কষ্ট ও কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেদের মধ্যে।’ (সূরা বালাদ : ৪)।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। তার জীবনের জন্য শুধু উত্তম অংশটিই থাকবে। মনের প্রশান্তি আনা ও দুশ্চিন্তা-বিষন্নতা দূর করা প্রত্যেক মানুষের কাম্য। এর মাধ্যমেই উত্তম, মর্যাদাকর ও সচ্ছল জীবন লাভ হয়। সব মানুষ সুখের সন্ধান করে এবং তা অর্জনে সচেষ্ট হয়। সুখ-শান্তির মূলে আছে অন্তরের প্রফুল্লতা ও হৃদয়ের প্রশান্তি। আল্লাহ কোনো বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করলে তার অন্তরকে প্রসারিত ও বিস্তৃত করে দেন। আর সেটাই হচ্ছে হেদায়েত ও সুখের অন্যতম বৃহৎ কারণ।
ইবনুল কায়্যুম (রহ.) বলেন, ‘অন্তরের উন্মোচন ও প্রসারণ যেমন হেদায়েতের কারণ ঠিক তেমনি তা সব ধরনের কল্যাণের ভিত্তি ও সুখেরও মূল।’ মুসা (আ.) বলেছিলেন, ‘হে রব, আমার জন্য আমার অন্তরকে উন্মোচিত করে দিন।’ (সূরা তহা : ২৫)।
আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি আপনার অন্তরকে আপনার জন্য প্রসারিত করে দিইনি?’ (সূরা ইনশিরাহ : ১)। শরিয়তের প্রদর্শিত পথই সুখ-শান্তি লাভের প্রধান ও পূর্ণাঙ্গ উপায়। আল্লাহর পরিচয় জানা, ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর একত্ব, তাঁর নাম ও গুণাবলি জানতে পারাই হৃদয়ের প্রফুল্লতার সবচেয়ে বড় উপায় ও কারণ। হৃদয়ের প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ ছিলেন। তাঁকে যে যত বেশি অনুসরণ করবে তার হৃদয়ের প্রফুল্লতা ও সুখও তত বেশি হবে।
হৃদয়ের প্রফুল্লতা আনার মূল পন্থা হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্ম। আল্লাহ বলেন, ‘যে পুরুষ ও নারী মোমিন অবস্থায় সৎকর্ম করেছে আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন প্রদান করব।’ (সূরা নাহল : ৯৭)। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা বান্দার হৃদয়কে প্রফুল্ল রাখে তা হলো আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর প্রতি মনোনিবেশ ও তাঁর ইবাদতের মাধ্যমে সুখ লাভ করা। বান্দার জন্য আল্লাহর পছন্দ তার নিজের পছন্দের চেয়ে বেশি উত্তম। যে আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার মন প্রশান্ত থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে তিনি তার হৃদয়কে পথ দেখিয়ে দেন।’ (সূরা তাগাবুন : ১১)।
মানুষের জীবন সুখ ও দুঃখ নিয়ে আবর্তিত হয়। এ থেকে কেউ কিছুতেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বিপদে ধৈর্য ধরলে আর সুখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে শান্তি পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মোমিনের বিষয়টি আশ্চর্যের, তার সবকিছুতেই কল্যাণ, মোমিন ছাড়া এটা কারও বেলায় হয় না। সে সুখ পেলে শোকর আদায় করে, ফলে সেটা তার জন্য কল্যাণকর হয়, সে বিপদে আক্রান্ত হলে ধৈর্য ধরে, ফলে সেটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।’ (মুসলিম)।
আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে অন্তরগুলো প্রশান্তি লাভ করে।’ (সূরা রাদ : ২৮)।
যে কোরআন তেলাওয়াত করে সে সুখ লাভের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘তহা! আপনি দুর্ভাগা হবেন এজন্য আমি আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ করিনি।’ (সূরা তহা : ১-২)। আল্লাহর তসবিহ পাঠ, তাঁর প্রশংসা, অধিক সেজদা ও নিয়মিত ইবাদতের মাঝে নিহিত আছে হৃদয়ের প্রশস্ততা ও দুশ্চিন্তার অবসান।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি তাদের কথায় আপনার অন্তর সংকীর্ণ হচ্ছে, তাই আপনি আপনার রবের প্রশংসা করে তসবিহ পাঠ করুন। সেজদাকারীদের দলভুক্ত হোন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার রবের ইবাদত করুন।’ (সূরা হিজর : ৯৭-৯৯)।
তাকওয়া অবলম্বন করলে দুশ্চিন্তা দূর হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার জন্য পথ তৈরি করে দেন।’ (সূরা তালাক : ২)। নামাজ দুঃখ-বেদনা দূর করতে সহায়ক। তা জীবনের আলো। ‘তোমরা নামাজ ও ধৈর্য দিয়ে সাহায্য কামনা করো।’ (সূরা বাকারা : ৪৫)। কোনো জটিল বিষয় ঘটলে রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের দিকে ছুটতেন। (আবু দাউদ)।
নামাজ দিয়ে বান্দা তার দিন শুরু করলে সারা দিনটিই তার সুন্দর হয়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, দিনের শুরুতে চার রাকাত নামাজ না পড়ে থেক না, তাহলে আমি তোমার বাকি দিনের জন্য যথেষ্ট হব।’ (আহমাদ)। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞান কর্মে ও আমলে যুক্ত হলে তা হৃদয়কে প্রশস্ত করে। এ জ্ঞানের অধিকারীরা সবচেয়ে বেশি প্রফুল্ল ও মহৎ হৃদয়ের হয়ে থাকেন। জ্ঞান যত বাড়ে তাদের উত্তম কর্ম ও আচরণও তত বৃদ্ধি পায়।
মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা কল্যাণকর বিষয়। তা শুধু কল্যাণই বয়ে আনে। অনুগ্রহশীল লোক প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়। নিঃস্বার্থ হয়ে মানুষের সঙ্গে আচরণ করলে মন প্রশান্ত থাকে। দোষ ও ঘৃণার চর্চা না করলে মানুষ প্রফুল্ল থাকে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মোমিন পুরুষ মোমিন নারীকে ঘৃণা যেন না করে, তার একটি বিষয় অপছন্দ হলে অন্য একটি বিষয় পছন্দ হবে।’ (মুসলিম)। সৎকর্মশীল, জ্ঞানী ও ধার্মিক লোকদের সান্নিধ্যে থাকলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয় এবং জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মনের প্রশস্ততা সৃষ্টি হয়।
শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে থাকলে শয়তান তার মাথার পাশে তিনটি গিঁট বেঁধে দিয়ে বলে, ‘রাত দীর্ঘ হোক, ঘুমিয়ে থাক।’ তারপর সে জেগে আল্লাহর নাম নিলে একটি গিঁট খুলে যায়। অজু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। নামাজ পড়লে বাকি গিঁটটাও খুলে যায়। তখন সে উদ্যমী ও প্রফুল্লচিত্ত হয়ে যায়, অন্যথায় সে অলস ও মন্দচিত্ত হয়ে পড়ে।” (বোখারি ও মুসলিম)।
মোমিনের শক্তি তার মনের প্রশস্ততার বড় উৎস। আল্লাহর অনুগ্রহের কথা মনে রেখে সব বিপদের সামনে সে থাকবে দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, অটল, অবিচল। অল্পে তুষ্ট থাকা প্রকৃত প্রাচুর্য। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যারা তোমাদের নিম্নস্তরে তাদের দিকে তাকাও এবং যারা তোমাদের উপরের স্তরে তাদের দিকে তাকিও না। এটাই তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতকে অবজ্ঞা না করার উপযুক্ত উপায়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
যে ব্যক্তি নিজের হৃদয়কে তার বর্তমান ও চলতি মুহূর্তের সঙ্গে নিবিষ্ট করে রাখে তার মন প্রশান্তি লাভ করে। সে অতীতের বিষয় নিয়ে দুঃখ করে না এবং ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় না। কেননা অতীত কখনও ফিরবে না আর ভবিষ্যৎ তো অদৃশ্যের লিখন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর একটি দোয়া হলো, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।’ (বোখারি)।
অবসর সময়ের দ্বারা উপকৃত না হওয়া দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতার উৎস। যে নিজের সময়কে সৎকর্ম বা উপকারী জ্ঞানের দ্বারা জীবন্ত করে তার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে উপকারী বিষয়ের সাহায্য কামনা করা ও যা কিছু বান্দাকে, তার হৃদয় ও কর্মকে দুর্বল করে দেয় তা থেকে দূরে থাকার মাঝেই নিহিত আছে সুখের সামগ্রিক রহস্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যা তোমার উপকার করে সে বিষয়ে যত্নশীল হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং অক্ষম হয়ো না। যদি কোনো বিপদে আক্রান্ত হও তবে বলো না, যদি এমন করতাম তবে এমন হতো, বরং বল, আল্লাহ ফয়সালা করেছেন, তিনি যা চান তা করেন। কেননা, ‘যদি’ শয়তানের কর্মের দ্বার উন্মোচন করে দেয়।” (মুসলিম)।
গোনাহ বান্দার দুঃখ-দুর্দশার দ্বার। গোনাহ করলে মন ভারাক্রান্ত থাকে। পাপ ছেড়ে তওবা করলে মনের প্রফুল্লতা আসে। হৃদয়কে রোগ-ব্যাধি থেকে পবিত্র করলে তার মধ্যে প্রশস্ততা আসে। জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের অন্তরের বিদ্বেষ বের করে দিয়েছি।’ (সূরা আরাফ : ৪৩)। ইসলাম যাবতীয় কল্যাণ ও সুখের মূল, শান্তির উৎস। ‘আল্লাহ যাকে সত্যের দিশা দিতে চান তিনি ইসলামের জন্য তার অন্তরকে উন্মোচিত করে দেন এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তার অন্তরকে সংকীর্ণ ও আড়ষ্ট করে রাখেন।’ (সূরা আনআম : ১২৫)। সূত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ।