একটু ফিরে যেতে চাই, ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ। ঢাকা সফরত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনার দম্ভভরে ঘোষণা করেন ‘উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।
২৪শে মার্চ কার্জন হলে একই ভাষণের পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। উভয় মিটিংয়েই তিনি দর্শক শ্রোতাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়েন। ২৮ শে মার্চ দেশত্যাগের পূর্বে রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আবারো তিনি এর উপর গুরুত্বারোপ করেন।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের (যা পরবর্তী সময়ে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল) ভিত্তিতে গঠিত তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্গালিরা রাষ্ট্রটির উষালগ্নেই নিজ মাতৃভাষা বিলুপ্তির তীব্র হুমকিতে পড়ে। নিজেদেরকে তারা বঞ্চিত ভাবল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়েই।
পুলিৎজার পুরষ্কার বিজয়ী ব্রিটিশ লেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ী ‘দ্য নিউইয়র্কার’ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন-“যখন আপনি এমন একটি দেশে বাস করবেন যেখান আপনার মাতৃভাষা বিদেশী হিসেবে পরিগণিত হয়, আপনার মধ্যে ক্রমাগত বিরহের বোধ কাজ করবে। আপনি কথা বলছেন গোপন অজানা এমন ভাষায় যার সাথে পরিবেশের কোন সম্পর্ক নেই। এই অনুপস্থিতি আপনার নিজের মধ্যেই দূরত্ববোধ তৈরি করবে।”
ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার পরিচয়ের সংকটে পড়া বাঙ্গালি জাতির এ বঞ্চনার বোধ এক সময় প্রতিবাদ, প্রতিরোধের পথ পরিক্রমায় রুপ নিল আন্দোলনে যার চূড়ান্ত পরিনতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে।
মাতৃভাষার প্রতি টান মানুষের নিউরনে প্রোথিত। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যেমনটি বলেছেন-“আপনি যদি কারো সাথে তার বোধগম্য ভাষায় বলেন তবে তা তার মাথায় ঢুকবে। আর যদি আপনি কারো সাথে তার মাতৃভাষায় কথা বলেন তবে তা তার হৃদয়ে প্রবেশ করবে।”
মাতৃভাষা কেবলমাত্র মায়ের কন্ঠ নিঃসৃত ভাষাই নয় বরং যে ভাষাকে আমরা মায়ের মতই ভালবাসি, স্নেহ করি, ধারণ করি, অনুভব করি, আপ্লুত হই সেটাই প্রকৃতপক্ষে মাতৃভাষা।
মাতৃভাষা রক্ষা করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক শহীদ।ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য সকল অংশগ্রহণকারীরা জাতির মানসপটে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আসনে চিরভাস্বর।
একুশের চেতনা শানিত করে জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামকে।ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাস থেকে রচিত হয় মুক্তির লড়াইয়ের অমর আলেখ্য। অকপটেই বলা যায়, ভাষার আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় বাঙ্গালি পায় তার কাঙ্খিত স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ । ভাষা থেকে স্বাধীনতা-এ দৃষ্টান্ত বোধ করি মানব ইতিহাসে অনন্য।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন,
ভাষার গভীরে ভাষা, চেতনার গভীরে চেতনা
এ যদি কানে না পশে,
বোধে যদি নাই এসে যায়
তবে তো বাহান্ন সাল একাত্তর কখনো পেত না
ভাষার গভীরে দেশ, দেশকন্ঠ রয়েছে ভাষায়।
বাঙ্গালির এ অনন্য অবদানের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি মিললো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের নিকট হতে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিল। ২০০০ সালে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে পালিত হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেনী, পেশা নির্বিশেষে সকল বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ল বাঙ্গালির মহান আত্মত্যাগের এ আখ্যান। বাঙ্গালিকে তারা স্থান দিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সুউচ্চ আসনে কেননা মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতি যে শুধু বাঙ্গালিই দিয়ে গেছেন।
প্রত্যেকের নিজ নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা ও আবেগ প্রকাশের উপলক্ষ এনে দিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। নিজ মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ, লালন ও পরিমার্জনের জন্য প্রত্যেক দেশেই গঠিত হচ্ছে মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট।
আজ সারাবিশ্বের সকল রাষ্ট্রেই পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিটি দেশেই সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে এ দিবসকে উপলক্ষ্ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রমান্যচিত্র প্রদর্শনী, লেখালেখিসহ নানাবিধ আয়োজন হচ্ছে। এর প্রতিটিতেই বাংলাভাষা ও ভাষার জন্য বাঙ্গালীর আত্মত্যাগের আখ্যান শত সহস্রবার উচ্চারিত হচ্ছে শতকোটি বিশ্ববাসীর কাছে। একজন বাঙ্গালি হিসেবে এর চেয়ে বড় গর্বের উপলক্ষ্য আর কি হতে পারে।
সারাবিশ্বের যেসব ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর লোকজন তাদের মাতৃভাষা বিলুপ্তির হুমকিতে আছে, তারা বিশ্বজুড়ে অমর একুশে উদযাপন করছে বাংলা ভাষার বিকাশকে স্মরণ করে, যে ভাষার ইতিহাস মানুষের ভাষাগত অধিকারের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পর্কিত।ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা আজ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ভাষা। সুদূর আফ্রিকার দেশ সিয়েরালিয়নের দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা ভাষা।
অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক যে, এ বছরের শেষে বাংলাদেশ সরকার ৫টি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের মধ্যে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার প্রি-স্কুল বই ও উপকরণ বিতরন করেছে।
বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, ৪টি মহাদেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষনা ও চর্চা হচ্ছে। ইংরেজি চীনা ও জাপানি ভাষার পরপরই বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর আগ্রহ বাড়ছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে চর্চা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষনা কেন্দ্রে বাংলাভাষার চর্চা হচ্ছে।
৩০টি দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইডেন, জামার্নি, চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চেক রিপাবলিক প্রমুখ। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপীই বাংলাভাষার প্রতি সকলের আগ্রহ বেড়েছে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দাম্ভিক ঘোষনায় বাঙ্গালি জাতির লোকজন স্তম্ভিত ও শ্ংকিত হয়েছিল মাতৃভাষা বিপন্নের তাড়নায়।বিখ্যাত বৃটিশ লেখক এইচ.জি. ওয়েলস এর বিখ্যাত সাইন্স ফিকশন-‘টাইম মেশিন’ এ বর্ণিত মেশিন এর সহায়তায় তাদেরকে যদি ২০১৭ সালে নিয়ে আসা যেত, নিশ্চিতভাবেই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত ও সুখী মানুষ হতেন। কেননা তাদের আত্মত্যাগের মহিমার জয়গান আজ সারাবিশ্বে গীত হচ্ছে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। প্রকৃতপক্ষেই কেউই তা ভুলতে পারবে না।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” বিশ্বব্যাপী পালিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বাঙ্গালির গৌরবের এ মহিমা তাই চিরজাগরুক থাকবে বিশ্বময়।
লেখক:
সুব্রত দাস
সাব ইন্সপেক্টর
মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।