একপাশে উচু পাহাড়ে সবুজের হাতছানি। অপরপাশে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়ির বুকে। এই দুইয়ের বুক চিরে মাঝখানে নদীর মত এগিয়ে গেছে পথ। পথের পাশে নানা প্রজাতির গুল্ম-লতা, ঝাউয়ের সারি মাতিয়ে তুলে মন। স্বপ্নের মত এই চিত্র বাস্তবে দেখা দেয় সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁষে নির্মাণাধীন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে।
কক্সবাজার জেলা শহরের কলাতলী থেকে সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার সাবরাংয়ে প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়ন (ইসিবি)। বর্তমানে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, বিশ্ব পর্যটনের দুয়ার খুলতে চলেছে সড়কটি। এটি পুরোদমে চালু হলে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার ক্ষেত্রে পর্যটকদের সময়ের অনেক সাশ্রয় হবে। তিন ঘন্টার পথ পৌঁছে যাবেন মাত্র এক ঘন্টায়।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া বলেন, ‘তিন ধাপে সড়কটি নির্মাণ করছে সেনাবাহিনীর ১৬ প্রকৌশল নির্মান ব্যটালিয়ন (ইসিবি)। পুরো কাজ শেষ হলে সড়কটি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মে মাসের শুরুতে (সম্ভাব্য ২ মে) সড়কটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করছি।’
সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা মো: ইয়াসির আরাফাত বর্তমানে জেলা শহরের একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কক্সবাজার সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তিনি প্রায় প্রতিদিনই নিজ বাড়ি থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক হয়ে কক্সবাজারে যাতায়াত করতেন। সেই অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক হয়ে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পৌঁছতে ৩ ঘন্টারও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। অথচ মেরীণ ড্রাইভ সড়ক ব্যবহার করে মাত্র এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে কক্সবাজার শহরে যাতায়াত করা যায়। যাত্রাপথে সড়কটির প্রাকৃতিক পরিবেশ মন জুড়িয়ে দেয়। অন্যরকম এক ভাললাগার শিহরণ জাগে মনে।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের কক্সবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কক্সবাজার মেরীণ ড্রাইভ প্রকল্পটি গ্রহন করা হয়। তখন প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। কক্সবাজার শহরের কলাতলী পয়েন্ট থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ নির্মাণ কাজও শুরু করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিযুক্ত ঠিকাদার কলাতলী মোড় থেকে পাইওনিয়ার হ্যাচারী পর্যন্ত নির্মিত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় সাগরেই বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই সড়কের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়নকে। বর্তমানে সড়কটির দৈর্ঘ্য বেড়ে ৪৮ কিলোমিটার থেকে ৮০ কিলোমিটার করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। তিন ধাপে নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে ইনানী থেকে শীলখালী ২৪ কিলোমিটার ও তৃতীয় ধাপে শীলখালী থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয় ধাপের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে জুন মাসের মধ্যে। সড়কটি নির্মাণে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চারশত ৫৬ কোটি টাকা।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, মেরীণ ড্রাইভ সড়কটির দুই পাশে থাকবে ওয়াকওয়ে। পর্যটকদের সুবিধার্থে থাকবে সড়কজুড়ে ফেক্সিবল পেভমেন্ট, শেড, গাড়ি পার্কিং ও চেঞ্জিং রুমের ব্যবস্থা। ৮০ কিলোমিটার সড়কে তিনটি বড় আরসিসি সেতু, ৪২টি কালভার্ট, তিন হাজার মিটার সসার ড্রেন ও ৫০ হাজার মিটার সিসি ব্লক ও জিও টেক্সটাইল। সেনাবাহিনী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে তা রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবে।