মশা নিধনে ‘স্মার্ট ফাঁদ’ বাজারে আনতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রযুক্তি কম্পানি। যার মাধ্যমে সহজে জিকা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও অন্যান্য রোগজীবাণুবাহী মশা নিধন করা যাবে । মাইক্রোসফট ও গুগলের মতো প্রযুক্তি কম্পানিগুলো এই উদ্যোগ নিয়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে মাইক্রোসফট ও গুগলের লাইফ সায়েন্স কম্পানি ভেরিলি।
টেক্সাসে এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে মাইক্রোসফটের স্মার্ট ফাঁদের। এই ফাঁদটি জিকা, ডেঙ্গুর মতো ইয়েলো ফিভারের জন্য দায়ী এডিস এজিপটি মশাগুলোকে আলাদা করে ধরে ফেলবে। যন্ত্রটি বিশেষজ্ঞদের এডিস মশার বিস্তার সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলছে গুগলের অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের উদ্ভাবিত যন্ত্রটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। গুগলের জীববিজ্ঞান বিভাগ এই প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য, এডিস এজিপটি মশার প্রজাতিগুলোর জন্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম এক ধরনের বন্ধ্যা পুরুষ মশা উদ্ভাবন করা, যা নারী মশার সঙ্গে মিলিত হয়ে এর বিস্তার কমাবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যাপকভাবে এর সুবিধা পেতে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা সত্য, উদ্ভাবকরা জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণে একটি নতুন চিন্তা হাজির করেছেন। এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইডের পতঙ্গবিদ্যা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক আনন্দ শঙ্কর রায় বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রযুক্ত কম্পানিগুলোর এগিয়ে আসা রোমাঞ্চকর বিষয়। সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাদের পদ্ধতিটি জীববৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ। ’
কেমন হবে স্মার্ট ফাঁদ : ২০১৫ সালে ব্রাজিলে জিকা মহামারি আকারে দেখা দেয়। এর ফলে কয়েক হাজার শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। পরে তা যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে জিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাগাদা সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে জিকায় আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ হাজার ৩৬৫টি ঘটনা ঘটে, যা পর্যটকদের মাধ্যমে ছড়ায়। স্থানীয় মশার মাধ্যমে জিকায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এখনো টেক্সাস ও ফ্লোরিডায় ঘটছে। ফলে নতুন প্রযুক্তি যাচাইয়ের জন্য সর্বাগ্রে গুরুত্ব পায় এ রাজ্য দুটি।
টেক্সাসের হ্যারিস কাউন্টিতে মাইক্রোসফট উদ্ভাবিত ১০টি স্মার্ট ফাঁদের ব্যবহার চলছে এ মুহূর্তে। রাজ্যের হিউস্টন সিটিও এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। গড়পড়তায় বড় পাখির বাসার (বার্ড হাউস) আকারের মতো মাইক্রোসফটের যন্ত্রটি হবে একটি রোবটিক। এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সম্ভাব্য জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা চিহ্নিত করতে পারবেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে টেক্সাসে স্থানীয় মশার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস সংক্রমণের ছয়টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে এর সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কারণ জিকায় আক্রান্ত হওয়া অনেক মানুষের দেহেই এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়নি।
সাধারণ প্রচলিত মশক ফাঁদগুলো এর সামনে আসা সব ধরনের পতঙ্গকেই টেনে আনে। কিন্তু মাইক্রোসফটের যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পতঙ্গগুলোকে আকার ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা করতে পারবে বিশেষ করে তাদের কামড়ানোর অঙ্গটিকে চিহ্নিত করে। ফাঁদটির ৬৪টি চেম্বার আছে। যখনই এর কোনো চেম্বার একটি এডিস এজিপটিকে শনাক্ত করবে, তখনই ওই চেম্বারটি বন্ধ হয়ে যাবে।
যন্ত্রটির উন্নয়নে কাজ করছেন মাইক্রোসফটের প্রকৌশলী ইথান জ্যাকসন। তিনি বলেন, ফাঁদ পাতার জন্য যন্ত্রটি কোথায় বসাতে হবে, সে বিষয়ে যন্ত্রটিই সিদ্ধান্ত দেবে। তিনি জানান, গত গ্রীষ্মে হিউস্টনে এর পরীক্ষা শুরু হয়। এতে দেখা গেছে, যন্ত্রটি এডিস এজিপটি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী মশাগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে ৮৫ শতাংশ সফল হয়েছে। যন্ত্রটি পতঙ্গ বিস্তারের উপযোগী পরিবেশগত পরিস্থিতি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সম্পর্কেও ধারণা দেবে, যাতে মশার মাধ্যমে রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্যাকসন জানান, যন্ত্রটি এখনো প্রটোটাইপ (উদ্ভাবনের প্রাথমিক নকশা) হিসেবে আছে। বাজারে নিয়ে এলে কম্পানি এটি কয়েক শ ডলারে বিক্রির চিন্তা করছে। এর মানে এটি মোটামুটি প্রচলিত মশক ফাঁদের দামেই পাওয়া যাবে। কম্পানির লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর ব্যবহার বাড়ানো।
অন্যদিকে গুগলের ভেরিলি জানিয়েছে, তাদের যন্ত্রটি রোবটের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মশা বাছাই করবে। এটি দ্রুত বাজারে আসবে এবং মূল্যসাশ্রয়ী হবে। কম্পানির কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাত্কার দিতে রাজি হননি। তাঁদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সেন্সর, অ্যালগরিদম ও ‘নভেল ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের সমন্বয়ে তাঁদের যন্ত্রটির উদ্ভাবন প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভেরিলি ও মসকুইটোমেট ইনকরপোরেশন এ বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করছে। তারা তাদের প্রযুক্তিটির পরীক্ষা চালাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেসনোতে।