কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, খুব শিগগিরি তারা মাওবাদী মোকাবিলার রণকৌশল পর্যালোচনা করবেন। ভারতে ছত্তিশগড় রাজ্যের সুকমায় সোমবার মাওবাদী বিদ্রোহীদের হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ২৫জন সদস্য নিহত হওয়ার পর এ ঘোষনা আসলো সরকারের তরফ থেকে ৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আরও বলেছেন, সরকার মাওবাদীদের ছুড়ে দেওয়া এই ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করছে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের বর্তমান স্ট্র্যাটেজিতে কোথায় ত্রুটি ছিল, যাতে এত জন সিআরপিএফ সদস্যকে প্রাণ দিয়ে তার দাম চোকাতে হল? মাওবাদীদের মোকাবিলায় সরকার নতুন পথই বা কী নিতে পারে?
ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মাওবাদী বিদ্রোহী বা নকশালদের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে একদা চিহ্নিত করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং – তার পরও সাড়ে সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে গোটা ভারতেই মাওবাদীদের শক্তি ক্রমশ খর্ব হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা একমত – কিন্তু এর মাঝেও কখনও দান্তেওয়াড়া, কখনও সুকমা, কখনও গয়া-পাকুড় বা শিলদায় বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে মাওবাদীরা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।
এই তালিকাতেই সবশেষ সংযোজন গতকাল সুকমার গভীর জঙ্গলে রীতিমতো ফাঁদ পেতে মাওবাদীদের চালানো হামলা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এদিন ছত্তিশগড়ে গিয়ে নিহত সিআরপিএফ সদস্যদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, সরকার এই হামলার উপযুক্ত জবাব দেবে।
সরকারি কৌশলের বিস্তারিত তিনি প্রকাশ করেননি, কিন্তু জানিয়েছেন ৮ মে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে রণকৌশল খতিয়ে দেখা হবে, মাওবাদীদের সঙ্গে লড়তে নতুন করে ঘুঁটি সাজানো হবে।
কিন্তু যে সরকার গত প্রায় দুবছর ধরে দাবি করে আসছে মাওবাদীরা প্রায় নির্মূল হতে বসেছে, পাল্টা আঘাত হেনে সেই সরকারকেই তারা কীভাবে এমন অপ্রস্তুত করে দিতে পারল?
দিল্লিতে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের অজয় সাহনি বলছেন, “মাওবাদীদের আন্দোলন দুর্বল হয়েছে কোনও সন্দেহ নেই। আর আন্দোলন দুর্বল হতে থাকলেই দুটো জিনিস ঘটে – এক, নিজেদের অস্তিত্ত্ব বাঁচাতে বিদ্রোহীরা মরিয়া আঘাত হানে। আর দুই, সরকারও আত্মতুষ্ট হয়ে ঢিলে দেয়।”
“যেমন, এর মধ্যেই নকশাল এলাকায় পুলিশ থানাগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য বা উন্নয়নমূলক স্পেশাল এরিয়া প্রোগ্রামের জন্য যে তহবিল বরাদ্দ ছিল তাতে কাটছাঁট শুরু হয়ে গেছে। সময়ের আগে বিজয় ঘোষণা করলে এই জিনিসই ঘটার ছিল।”
দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নন্দিনী সুন্দর, যিনি মাওবাদী-অধ্যুষিত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন, তিনি আবার মনে করেন আগাগোড়াই মৌলিক ত্রুটি ছিল সরকারের মাওবাদী দমন নীতিতে।
প্রফেসর সুন্দর বলছেন, “বাহিনী পাঠিয়েই এর সমাধান করা যাবে সেটা ভাবাটাই ভুল। যেখানে এই ঘটনাটা ঘটেছে, সেখানে মাত্র ৯০ কিলোমিটার রাস্তা বরাবর পাঁচটা পুলিশ থানা আর পনেরোটা সিআরপিএফ ক্যাম্প আছে। তারপরও কেন হামলা ঠেকানো গেল না, সরকারকে তা অবশ্যই ভাবতে হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা বহুদিন ধরেই বলে আসছি ওখানে শান্তি আলোচনা শুরু কর – মাওবাদীদের সঙ্গে বসতে রাজি না-থাকলে অন্তত গ্রামবাসীদের সঙ্গে তো কথা বলা হোক। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর অন্তত প্রতিকার হোক।”
প্রচুর সংখ্যায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের নীতি কাজে না-দিলে সরকারের সামনে তাহলে বিকল্পটাই বা কী?
ছত্তিশগড়ে মাওবাদী দমনে নিয়োজিত আছে বিএসএফ, সেই বাহিনীর সাবেক প্রধান প্রকাশ সিং মনে করেন ব্যাক টু বেসিকস – অর্থাৎ সমস্যার মূলে ফিরে যাওয়াটাই একমাত্র সমাধান।
তার মতে, “নকশালবাদ তৈরিই হয়েছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর দুর্নীতির কারণে। ফলে সরকার যদি নিজের ঘর ঠিকঠাক গোছাতে পারে তাহলে এই সমস্যা নিজে থেকেই শেষ হয়ে যাবে। তা ছাড়া মাওবাদের আবেদনও স্তিমিত হয়ে এসেছে, রাশিয়া-চীন অনেক আগেই এই আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছে, ফলে নতুন ক্যাডার তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।”
ভারতের মাওবাদী দমনের নির্দিষ্ট কৌশলটা ঠিক কী, কোনও সরকার কখনওই তা নথিপত্রের আকারে প্রকাশ করেনি।
কিন্তু সেই কৌশল ২০১৭তে এসে আদৌ কার্যকরী থাকছে কি না, সুকমার হামলা সরকারকে তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।