কিছু লোকের জিজ্ঞাসা, একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও দাসত্ব কিভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে? ইসলাম এর উত্তরে আল্লাহর দাসত্বের কাঠামোয় নারীর পরম স্বাধীনতা প্রমাণ করেছে। নারীর নগ্নতা, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, অনৈতিকতা এবং ফ্যাশনের নামে খোলামেলা পোশাকে নিজেকে অন্যের কাছে আবেদনময়ী করে তোলার প্রচেষ্টা ও নানাবিদ মিথ্যা মোহ নিঃসন্দেহে দাসত্ব—যা কোনোভাবে নারীর স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং নারীর স্বাধীনতা রক্ষা হয় আল্লাহ প্রদত্ত মূল্যবোধ ও জীবনবিধান আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে। এই মূল্যবোধ তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত। যেগুলো কখনো বিচ্ছিন্ন বা ম্লান হওয়ার নয়।
প্রথমটি হলো মেধাবুদ্ধি—যা জ্ঞান ও নৈতিকতাকে আকর্ষণ করে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় মেলে, তাঁর নৈকট্য লাভ হয়। সত্য ও ভালো কাজে মেধা-বুদ্ধির ব্যবহারে আল্লাহর দাসত্ব সুনিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়টি হলো আত্মা—যা নৈতিকতা এবং আল্লাহর ভয় ও দয়া লাভে প্রশান্তি লাভ করে। তৃতীয় উপাদান হলো দেহ—যা সুস্থতা বজায় রাখে, সংরক্ষণ করে এবং উপভোগ করে। আর আল্লাহর বৈধ ব্যবস্থাপনার মধ্যে খাদ্য, পানীয় এবং যৌন চাহিদা পূরণ করে। মৌলিক এই তিন উপাদান নারী ও পুরুষ উভয় সমানভাবে লাভ করেছে।
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নারী ঘরের রানি। তারা অর্থ-সম্পদের ব্যবহার ও কাজকর্মে স্বাধীন যতক্ষণ তারা নিজের নারীত্ব, সতীত্ব ও শালীনতা বজায় রেখে চলবে এবং মাতৃত্বের বৈশিষ্ট্যাবলির বিপক্ষে অবস্থান না নেবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চাৎপদতা ও দাসত্বের সব অভিযোগ অস্বীকার করে নারী একজন মা, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা, চিকিৎসক হিসেবে সব অধিকার ভোগ করেছে। বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়ে রানিতে পরিণত হয়েছে।
নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা বিষয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, তার বেশির ভাগই বিদ্বেষপ্রসূত ও ভিত্তিহীন। হয়তো তারা জানে না, ইসলামে নারীর বিশাল ভূমিকা ও অবস্থান রয়েছে, নতুবা তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা এমন করছে।
নারীবাদীরা নারীর স্বাধীনতা, মুক্তি ও অধিকার আদায়ের কথা বলে। তারা মুসলিম সমাজের প্রতি নারীর অধিকার হরণের অভিযোগ করে। অথচ পশ্চিমা রীতিতে নারীর অধিকার দাবি নারীত্বের প্রতি অবমাননা। তারা মুসলিম নারীদের চরিত্রহনন ও পশ্চিমা নারীদের মতো তাদের কুরুচিপূর্ণ জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তুলতে চায়। যারা এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে, তারা নিজেদের নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয় এবং অন্যদের বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। তাদের ধারণা, ইসলামের পশ্চাৎপদতা ও তার বিশ্বাসের শৃঙ্খল, মাতা-পিতা ও স্বামীর কর্তৃত্ব এবং সামাজিক অনুশাসন থেকে মুক্তিতেই রয়েছে নারীর স্বাধীনতা। তারা নারীর মানসিক ও শারীরিক দুরবস্থার আশঙ্কার কথা বলে, তাদের ওপর ধর্মীয় ও সামাজিক বশ্যতার ভয় দেখায়; তাদের পূতপবিত্র ও সতীসাধ্বী জীবনের বিপরীতে স্বাধীনতা, সমানাধিকার ও আত্মনির্ভরশীলতা, যৌবন-জীবন উপভোগ, শারীরিক সৌন্দর্য প্রকাশে উৎসাহিত করে। মূলত তারা মানুষকে পরিবার ও সমাজ থেকে পৃথক করে কথিত ‘মুক্ত পৃথিবী’র দাস বানাতে চায়। এই দাসত্বের জীবন যাপন করে পশ্চিমা বিশ্বের নারীরা এখন ক্লান্ত, হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত। নারীত্বের সম্মান ও মাতৃত্বের স্বাদ কোনোটিই তারা পাচ্ছে না। ইসলাম নারীর যে সুমহান মর্যাদা দিয়েছে, তার সঙ্গে পশ্চিমা সভ্যতায় নারীর বর্তমান অবস্থানের তুলনা করার সুযোগ নেই। ইসলামী পরিবার ও সমাজের মূলভিত্তি নারী। তাই ইসলাম তার গায়ে কোনো আঁচড় লাগার সুযোগ দিতে চায় না। তিনি একজন স্নেহময়ী মা, একজন পুণ্যবান স্ত্রী, একজন সম্মানিত বোন। তার শিক্ষালয় থেকেই আদর্শ ও যোগ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
পশ্চিমা সমাজে স্বাধীনতার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেখানে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের বিকাশ মূল্যহীন। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধ নিষ্প্রয়োজন। আর নারী হয়তো ভোগের পণ্য, নয়তো অবহেলিত। মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি যে বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে, পশ্চিমা সমাজে তা অনুপস্থিত। খ্রিস্টধর্ম প্রচারক স্যামুয়েল মারিনাস জুইম্মার বলেন, ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য শুধু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা নয়; বরং মুসলিমদের অন্তর ঈমানশূন্য করা। এর সংক্ষিপ্ত পথ হলো—যেকোনো উপায়ে মুসলিম নারীদের আয়ত্ত করা। কেননা সে-ই আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে ইসলামী সমাজকে বিকৃত করতে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধশূন্য করতে।
নারীবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ড. হেনরি ম্যাকাও নারীমুক্তি আন্দোলনের মিথ্যাচার উন্মোচন করেছেন। তিনি এই আন্দোলনকে প্রতারণা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আধুনিক বিশ্ব পরিচালনায় নারীমুক্তি একটি প্রতারণার নাম। এটি নিষ্ঠুর প্রতারণা, যা মার্কিন নারীদের বিপথগামী করেছে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে।
যেসব নারী মুক্ত, স্বাধীন, আত্মোন্নত এবং আত্মনির্ভরশীল হতে চায়, তাদের আমি বলব, বিপ্লবী হোন। তবে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বিপ্লবী হোন। নির্বুদ্ধিতা ও ছলনার শিকার হয়ে নয়। বিপ্লবী হোন আপনার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বিপক্ষে ও আপনার ওপর অর্পিত নবদায়িত্বের বিরুদ্ধে—যা আপনাকে আপনার মূল দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মুক্ত হোন ফ্যাশনের কুঠির এবং স্বাধীনতার মিথ্যা দাবি থেকে। জেনে রাখুন, আপনার স্বাধীনতা তখন শেষ হয়ে যাবে, যখন আপনার জন্য অঙ্কিত জীবনচিত্র, সৃষ্ট ধ্যানধারণা এবং আঁটসাঁট ফ্যাশনে বন্দি হবেন। স্বাধীন হোন প্রকৃত মূল্যবোধের ফ্যাশন গ্রহণের ক্ষেত্রে। প্রবন্ধের শুরুতে মেধা-বুদ্ধি, আত্মা ও দেহের যে কাঠামোর কথা আলোচনা করেছি, সেটি হলো প্রকৃত মূল্যবোধ। যে মূল্যবোধ সতীত্ব, শালীনতা, প্রজ্ঞা, দর্শন ও আল্লাহর দাসত্বে পূর্ণ স্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
আলজাজিরা ব্লগ থেকে সাইফ মুরতাফির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ
তথ্য সূত্র: কালের কন্ঠ।